নিজেস্ব প্রতিবেদক: দরজায় কড়া নাড়ছে বিদায় ঘন্টা। স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ২০২৪। আর মাত্র একদিন পরেই ২০২৩ সালের অবসান ঘটতে চলেছে। নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে এ পৃথিবী। কিছু প্রাপ্তির আনন্দের পাশাপাশি কিছু হারানোর ব্যথাও যোগ হয়েছে চলতি বছরে। বাংলাদেশের সাহিত্য, কৃষি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, স্থাপনা ও শিল্পাঙ্গনের বেশ কয়েকজন আলোকিত মানুষকে হারিয়েছি আমরা এ বছর। যারা পরম শ্রদ্ধেয় এবং চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের বাংলাদেশীদের স্মৃতিপটে। তন্মধ্যে বিশেষভাবে কয়েকজন বরেণ্য মানুষদের কথা না বললেই নয়।
ডাক্তার জাফুরুল্লাহ চৌধুরী
জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য সক্রিয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়ন ও ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া জাফুরুল্লাহ চৌধুরী তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ বছর ১১ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮১ বছর।
এফআরসিএস পড়াকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি শিক্ষা শেষ না করেই দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধকালীন সময়ে ডা. এম এ মবিনের সাথে মিলে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন, যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন। ডাক্তার জাফুরুল্লাহ’র এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরবর্তীতে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন থেকে রামন ম্যাগসাইসাই ও ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড পুরষ্কার লাভ করেন। তাছাড়া ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ ও মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কারও পান তিনি।
চিত্রনায়ক ফারুক
সার্টিফিকেট নাম আকবর হোসেন পাঠান। ডাক নাম ফারুক। ফারুক নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, সব পরিচয়েই ছিলেন তিনি স্বনামে উজ্জ্বল। অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীদের কাঁদিয়ে চলতি বছরের ১৫ই মে ৭৪ বছর বয়সে নায়ক ফারক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড়পর্দায় নায়ক ফারুকের অভিষেক ঘটে। ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে ভূষিত হয়েছেন আজীবন সম্মাননায়। ফারুক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে সারেং বৌ, লাঠিয়াল, সুজন সখী, নয়নমনি, মিয়া ভাই, গোলাপী এখন ট্রেনে, আলোর মিছিল ইত্যাদি।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন
স্থপতি, ক্রীড়া সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন ৭৯ বছর বয়সে এ বছর ২রা জানুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ও পরিবেশকর্মী মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন এসোকনসাল্ট লিমিটেডের প্রধান স্থপতি। কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল, এশিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক মোবাশ্বের হোসেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এবং সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক।
এছাড়াও পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনে সোচ্চার এই স্থপতি ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’এর আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সহ-সভাপতি ছিলেন।
মোবাশ্বের হোসেনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা এই স্থপতি দেশের বেশ কয়েকটি আলোচিত স্থাপনার কাজ করেছেন। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, প্রশিকা ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক ভবন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কথাসাহিত্যিক পান্না কায়সার
বরেণ্য কথাসাহিত্যিক পান্না কায়সারক। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার ৭৩ বছর বয়সে মারা যান। ৪ঠা আগস্ট তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণার স্বীকৃতিসরূপ ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে— মুক্তিযুদ্ধ : আগে ও পরে, নীলিমায় নীল, হৃদয়ে বাংলাদেশ, অন্য কোনোখানে, তুমি কি কেবলি ছবি, রাসেলের যুদ্ধযাত্রা, সুখ, না চুনি না পান্না প্রভৃতি।
চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান
১৯৬০ সালে রাজধানী ঢাকায় জন্ম নেওয়া বহু সফল চলচ্চিত্রের নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান এ বছর ১৩ই আগস্ট ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমে চলে যান। মৃত্যুকালের তার বয়স হয়েছিলো। তবে, অত্যন্ত ব্যাথাতুর বিষয় হলো, স্বীয় স্ত্রীর মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই তিনিও মারা যান।
সোহানুর রহমান সোহান ১৯৮৮ সালে চলচ্চিত্রে কর্মজীবন শুরু করেন শিবলি সাদিকের সহকারী হিসেবে। পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সোহানের প্রথম চলচ্চিত্র ছিলো ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’। এই গুণী নির্মাতার হাত ধরেই সালমান শাহ, মৌসুমী, পপি ও ইরিন জামান চলচ্চিত্রে আসেন। শাকিব খানের মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমার পরিচালকও ছিলেন তিনি।
সোহানুর রহমান সোহানের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো- ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’, ‘আমার দেশ আমার প্রেম’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’।
সোহানুর রহমান সোহান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে টানা দু’বার মহাসচিব এবং দু’বার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখার কারণে তিনি বাচসাস পুরষ্কারে ভূষিত হন।
কৃষিবিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা
আধুনিক কৃষি গবেষণার পথিকৃৎ, কাজী পেয়ারার জনক হিসেবে খ্যাত, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এ বছর ৩০শে আগস্ট ইন্তেকাল করেন এ কৃষিবিজ্ঞানী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৬ বছর।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পাকিস্তান কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদ পরিত্যাগ করে ১৯৭৩ সালে তিনি দেশের কৃষি গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কৃষি গবেষণার সংস্কার, উন্নয়ন ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তার হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি গবেষণার বুনিয়াদ রচিত হয়।
বরেণ্য এই কৃষিবিজ্ঞানী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের শীর্ষপদে দীর্ঘদিন নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা এদেশে পেয়ারার একটি জাত উদ্ভাবন করেন, যা তার নামানুসারে 'কাজী পেয়ারা' নামকরণ করা হয়েছে ।
এছাড়া ধানের বাইরে বাংলাদেশের প্রধান দুটি দানাদার ফসল চাষ শুরুর ক্ষেত্রেও তিনি নেতৃত্ব দেন। দেশে আধুনিক জাতের গম উদ্ভাবন ও চাষ শুরু করা এবং ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদ তার হাত দিয়েই শুরু হয়। ভুট্টা থেকে তেল উদ্ভাবন এবং তা পোলট্রিশিল্পের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরুর ধারণাটিও তার দেওয়া। ছত্রাকের গণ 'কাজিবোলেটাস' এর নামকরণও করা তার নাম থেকেই রাখা হয়েছে।
দেশের কৃষি গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য তাকে ২০১২ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়।
কবি আসাদ চৌধুরী
কাঁধে ঝোলা, সর্বদা মুখে মৃদু হাসি, ঢিলেঢালা রঙ বেরঙয়ের শার্ট, কখনো ফতোয়া বা পাঞ্জাবি পরা প্রেমের কবি আসাদ চৌধুরী। কথা বলতেন শুদ্ধ বাংলায়। সহজ-সরল মনের এ কবি কথা বলতেন খুব মিষ্ট ভাষায়।
ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী ৫ই অক্টোবর ৮০ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান। কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে তবক দেওয়া পান, বিত্ত নাই বেসাত নাই, প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়, জলের মধ্যে লেখাজোখা, যে পারে পারুক, মেঘের জুলুম পাখির জুলুম, নদীও বিবস্ত্র হয়, বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই, কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি, ঘরে ফেরা সোজা নয় প্রভৃতি।
(এনডিটিভি/৩০ ডিসেম্বর/এসএন)