ডেস্ক রিপোর্ট: শেরপুরের সীমান্তবর্তী তিনটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গারো পাহাড়। গারো পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুম শুরু হতেই প্রতিদিনই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বনের একটি বড় অংশ পুড়ে ছাই হয়েছে। মারা যাচ্ছে বনের কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গুল্মজাতীয় ঔষধি লতাপাতা ও বনের গাছ। মরে যাচ্ছে শাল গজারি গাছের চারা। হুমকির মুখে পড়েছে বন্যপ্রাণীদের জীবন ও জীববৈচিত্র্য।
তবে কে বা কারা আগুন দিচ্ছে বনে, জানে না কেউই। বন বিভাগ বলছে, প্রতি বছরই দিনে ও রাতের বিভিন্ন সময় এই আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। স্বল্প লোকবল নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন বনপ্রহরীরাও।
বনবিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ের মধুটিলা, রাংটিয়া ও বালিজুড়ি রেঞ্জসহ জেলায় প্রায় ২০ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিনই বনের বিভিন্ন জায়গায় আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। গত তিন দিনে ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা, রাংটিয়া, হালচাটি, গান্ধীগাঁও, গজনী বিট, দরবেশ টিলা এলাকার বিস্তৃত শালবনের কমপক্ষে ২০টি জায়গায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। শেরপুরের গারো পাহাড়ের শাল গজারির বনটি মূলত পত্রঝরা বন। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এই বনের গাছ থেকে প্রচুর শুষ্ক পাতা ঝরে পড়ে। এই পাতাতেই আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এই আগুনে মারা যাচ্ছে বনের পাখি ও উপকারী কীটপতঙ্গ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা শালবনের চারা গাছ। হুমকিতে পড়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বনভূমি ও বনে বসবাসকারী প্রাণীরা। গুল্মজাতীয় লতাপাতা এবং ঔষধি গাছ পুড়ে যাওয়ায় খাদ্যের অভাব দেখা দিচ্ছে বন্যপ্রাণীদের। এভাবে আগুন দেওয়া চলতে থাকলে বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি বনের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
সীমান্ত সড়কের রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বিট এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ি সীমান্ত সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন স্থানে বিশাল এলাকাজুড়ে আগুনে পুড়ে ঝরে পড়া পাতা ও ছোট ছোট চারা গাছগুলো ছাই হয়ে আছে। পুড়ে গেছে পাহাড়ি মাটিও। স্থানীয়রা বলছেন, বনের ভেতর একটি অসাধু চক্র নিজেদের সুবিধার্থে এই কাজ করে থাকে। আগুন দিয়ে বন পরিষ্কার করে সেখানে চাষাবাদ ও আগুনে পুড়ে কোন গাছ মরে গেলে রাতের আঁধারে চুরি করার অভিযোগও রয়েছে।
রাংটিয়া এলাকার যুবক সাদ্দাম হোসেন জানান, এ আগুনে শুধু বিভিন্ন গাছপালা ও কীটপতঙ্গই ধ্বংস হচ্ছে না। এর সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতিও। কিছু দুষ্কৃতকারী আছে যারা পাহাড়দ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী তারাই পাহাড়ে আগুন দেয়। তারা এই বনকে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে চায়। তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা বনবিভাগসহ সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
ছোট গজনী এলাকার সামাজিক বনায়নের অংশীদার মো. হুরমুজ আলী বলেন, বনে বেশি পরিমাণ পাতা জমা হওয়ায় বিড়ি সিগারেটের আগুন থেকেও আগুন লেগে যাচ্ছে। বাইরে থেকে আসা পর্যটকরাও না বুঝে বিড়ি-সিগারেটের আগুন ফেলছে। আমরা আগুন নেভাতে বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে কাজ করি। তবে কে বা কারা আগুন দিচ্ছে তাদের ধরা যাচ্ছে না।
রাংটিয়া এলাকার কৃষক হামিদুল্লাহ জানান, বনে আগুন লাগল শুকনা পাতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে বন বিভাগের লোকজনদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না।
গজনীতে বেড়াতে আসা পর্যটক শোয়াইব হাসান বলেন, যেহেতু শুষ্ক মৌসুম চলছে। তাই এই সময় বনকে আগুন থেকে রক্ষা করতে বন বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে নতুন গাছ বড় হতে পারবে না। আগুনে বন ধ্বংস এবং বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে গেলে গারো পাহাড়ে পর্যটকও আসবে না। তাই কঠোর নজরদারির মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা হোক।
পরিবেশবাদী সংগঠন শাইন এর নির্বাহী পরিচালক ও ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার মো. মুগনিউর রহমান মনি বলেন, গারো পাহাড়ে আগুন দিয়ে গাছপালা ধ্বংসসহ প্রাণী ও কীটপতঙ্গ হত্যা করছে একদল দুর্বৃত্ত। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আমাদের অনুরোধ, বন বাঁচাতে দ্রুত বনে নজরদারি বাড়িয়ে এসব দুর্বৃত্তকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের রেঞ্জার মো. আব্দুল করিম বলেন, এই আগুন নতুন কিছু না। প্রতি বছরই এমনভাবে বনের ঝরে পড়া পাতায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। তবে এবার এই রেঞ্জে আগুন দেওয়ার ঘটনাটা বেশি। আগুনের কারণে কীটপতঙ্গ ও বনের ছোট ছোট গাছপালা ঝোপঝাড় পুড়ে যাচ্ছে। এতে বনের ইকোসিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটছে। আমরা স্বল্প লোকবল নিয়ে আগুন মোকাবেলায় চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এস.বি তানভীর আহমেদ ইমন বলেন, এখন শুকনো মৌসুমে শাল পাতা খুবই শুষ্ক অবস্থায় বনে পড়ে স্তূপ হয়ে থাকে। এক জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না আনতেই আরেক জায়গায় আগুন জ্বলছে। আমাদের স্বল্প জনবল দিয়ে এত বড় পাহাড়ের আগুন নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন। তার পরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আগুনের ঘটনায় গত শনিবার (৮ মার্চ) রাতে ঝিনাইগাতী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করা হয়েছে। এসব আগুনের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।