নিজস্ব প্রতিবেদক : হাইকোর্টের আদেশ জালিয়াতি করে তিন পার্বত্য জেলায় ইটভাটা চালানোর সঙ্গে জড়িতরা ছাড় পাবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আদালত। জাল-জালিয়াতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় ফৌজদারি মামলা করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদেশ জালিয়াতির এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরাও।
বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বুধবার (১১ ডিসেম্বর) জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেন।
হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ জালিয়াতি করে ‘ইট উৎপাদন অব্যাহত থাকবে’ এই লাইন জুড়ে দিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় ইটভাটা সচল রেখেছিলেন ৫১ ইটভাটার মালিক। জালিয়াতি করে তৈরি করা আদেশে আবেদনকারীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে অতিরিক্ত ১৯ জনের নাম।
জালিয়াতি করা আদেশে মামলা সংশ্লিষ্ট নন, এমন বহিরাগত ব্যক্তিদেরও করা হয় হাইকোর্টের মামলায় বাদী। পাল্টানো হয় আদেশের তারিখ। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। জালিয়াতির এ ঘটনা ধরা পড়ে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় (খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি) অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। একই বছরের ২৫ জানুয়ারি এক আদেশে তিন পার্বত্য জেলায় অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়ে তা বাস্তবায়নে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানান, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ইটভাটার মালিকরা আপিল বিভাগে গেলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় আংশিক সংশোধন করে রায় বহাল রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের অংশ হিসেবে তিনি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জেলা প্রশাসক থেকে জানানো হয়, ইটভাটার কার্যক্রম চালু রাখা সংক্রান্ত একটি আদেশ তারা পেয়েছেন।
তিনি বলেন, আদেশটি সংগ্রহ করার পর দেখা যায়, ইটভাটার কার্যক্রম চলমান রাখতে গত ২ ডিসেম্বর আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হলে গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের নজরে আনা হয়। আদালত নথি ঘেঁটে দেখে, এ ধরনের কোনো আদেশ তারা দেয়নি। তারা ইটভাটার মালিকদের আবেদনটি নিষ্পত্তি করতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের তথ্যমতে, ইটভাটার কার্যক্রম চালু করতে সম্প্রতি হাইকোর্টে দুটি পৃথক রিট আবেদন করা হয়। যার নম্বর ১৪৩৬২/২৪ ও ১৪৩৬৩/২৪। এতে ১৬ জন করে দুটিতে ৩২ জন বাদী হন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৬ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি ফাতেমা নজিবের নেতৃত্বে গঠিত সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের উদ্দেশে রুলসহ অন্তর্র্বতীকালীন আদেশ দেন।
আদেশে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রিট আবেদনকারীদের পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে করা আবেদন ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে রিট আবেদনকারীদের লাইসেন্স ও পরিবেশগত ছাড়পত্র না দেওয়া কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, ইটভাটা চালু করতে ইটভাটা মালিকদের আবেদন নিষ্পত্তি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে তিন সপ্তাহের রুল দেয় হাইকোর্ট।
পরিবেশ ও বনসচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
কিন্তু ইটভাটার কার্যক্রম চালু করতে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন খাগড়াছড়ির বেশ কিছু ইট ভাটা মালিক। আদালত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে তাদের (ইটভাটা মালিক) দেওয়া আবেদন নিষ্পত্তি করার আদেশ দেন। তবে হাইকোর্টের এ আদেশকে পাল্টে দিয়ে নেওয়া হয়েছে জালিয়াতির আশ্রয়। আদালত ইটভাটায় উৎপাদন চলমান রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন এমন আদেশ তৈরি করে ইটভাটা চালু রাখতে চেয়েছিলেন মালিকরা।
মূল রিটে পৃথক দুটি রিট আবেদনে অভিন্ন আদেশ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের এই আদেশের অনুলিপি প্রকাশ হয় গত ১ ডিসেম্বর। কিন্তু জাল করা আদেশে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২ ডিসেম্বর।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর মুহাম্মদ আজমী বলেন, হাইকোর্ট আবেদন নিষ্পত্তিসহ রুল দিয়েছিলেন। কিন্তু রিট পিটিশনাররা হাইকোর্টের আদেশকে বিকৃত করে জাল আদেশ তৈরি করে। হাইকোর্ট তার আদেশে ইটভাটার উৎপাদন চালুর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না দিলেও তারা উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখার আদেশ তৈরি করে। এমনকি রিট মামলায় সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তিদেরও জাল করা আদেশে বাদী করা হয়েছে। একটিতে অতিরিক্ত বাদী করা হয়েছে ৯ জনকে। অন্যটিতে অতিরিক্ত বাদী করা হয়েছে ১০ জনকে।
তিনি বলেন, এখানে দুইভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট ইটভাটা চালুর কোনো আদেশ না দেওয়ার পরও জাল আদেশ তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে রিট মামলাসংশ্লিষ্ট নন, এমন ব্যক্তিদের বাদী করা হয়েছে। এমন জালিয়াতিকে সহজভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হাইকোর্ট বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন।
রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী সজল মল্লিক। তিনি বলেন, ২৬ নভেম্বর আদেশের পর ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ করে রিটকারীদের দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে তারা (রিটকারী) ২ ডিসেম্বর তারিখ উল্লেখ করে আদেশ টেম্পারিং করেছে। বিষয়টি আমি গত ৮ ডিসেম্বর জানতে পেরে আদালতকে অবহিত করেছি। আদেশ জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কী হয়েছে, তা নিয়ে আমার ধারণা নেই।
তবে বিষয়টি হাইকোর্টে উপস্থাপনকারী পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, তিন পার্বত্য জেলার অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়ে ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দেন হাইকোর্ট। পরে গত ১১ ডিসেম্বর আদেশে হাইকোর্ট জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর মুহাম্মদ আজমী আরো বলেন, জালিয়াতির ঘটনাটি নজরে আনা হলে আদালত এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় ফৌজদারি মামলা করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইটভাটা মালিকদের রিটের পক্ষে আদালতে থাকা আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, আমরা সঠিক আদেশের সার্টিফাইড কপি পাঠিয়েছিলাম। তার অনুলিপিও আমাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীসময়ে কেউ আদেশ টেম্পারিং করেছে। এ বিষয়ে আমরা অবগত নই।
এনডিটিভিবিডি/১৩ডিসেম্বর/এএ