নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘লোক জড়ো করুক, আর যাই করুক, আমি আপনাদের একটা অনুরোধ করি, এমন কিছু করবেন না যে আপনাদের (আওয়ামী লীগ) জীবন বিপন্ন হয়। এ দেশের পাবলিক এখনো আপনাদের গ্রহণ করতে আসেনি। আমি বরং মনে করি, আপনারা আপনাদের পার্টি রিঅর্গানাইজ (পুনর্গঠন) করুন।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত আনসার সদস্যদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) দেখতে গিয়ে সোমবার সকালে এম সাখাওয়াত হোসেন এ কথা বলেন।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অনেক অবদান আছে উল্লেখ করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। দলকে পুনর্গঠন করুন, রাজনৈতিক দলের মতো যেভাবে থাকে, নির্বাচন এলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, জনগণ ভোট দিলে ভোটে যাবেন।’
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আপনারা (আওয়ামী লীগ) এই দেশকে আরেকজনের হাতে তুলে দেবেন? তাহলে আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করলাম, ৩০ লাখ লোক মারা গেল, সেই ৩০ লাখ লোকের ওপর দাঁড়িয়ে দেশটা আপনি আরেকজনের হাতে তুলে দেবেন? এ দেশের লোক এত তাড়াতাড়ি ভোলেনি। কারণ, যাঁকে ধরছিলেন নেতা, সেই নেতারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যাঁকে ধরছে, সেই নেতাকে আমরা বাঁচাতে পারছি না। অনেক নেতাকে অনেকে বাঁচিয়েছেন, আমরা জানি না এ কথা।’
মারামারি করে কোনো লাভ নেই উল্লেখ করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এখানে আরও কিছু লোকের মৃত্যু আমরা চাই না। ইতিমধ্যে ৫০০, হয়তো আরও বেশি মারা গেছেন উভয় পক্ষের। পুলিশের এই অবস্থা হয়েছে। আনসারের এই অবস্থা হয়েছে। আমরা যদি উসকানি দিতাম, আপনারা টিকতে পারতেন না। আমরা আর্মিকে মানা করেছি। কারণ, কাকে মারবেন আপনি? পুলিশকে দিয়ে কাকে মারিয়েছেন? পুলিশকে দিয়ে মারিয়েছেন আপনার সন্তানকে। একজন পুলিশের সদস্য কী বললেন যে, স্যার, কয়টা গুলি লাগে, তাঁর ছেলে লাশ। এটা করবেন না। অনুরোধ করছি, প্ররোচনায় আসবেন না। ব্যক্তিগত স্বার্থে আপনারা এত বড় একটা দলকে নষ্ট করবেন না। এটা (আওয়ামী লীগ) আমাদের গর্ব। এটা নষ্ট করার কোনো অধিকার নেই।’
প্রতিবিপ্লবের জন্য হাজার হাজার মানুষের রক্তের প্রয়োজন উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আর কেউ যদি মনে করেন যে আবার একটা কাউন্টার রেভল্যুশন (প্রতিবিপ্লব) করে আসবেন, কাউন্টার রেভল্যুশন করতে হলে হাজার হাজার লোকের রক্তের প্রয়োজন। যদি আপনারা সেই দায়িত্ব নিতে চান, তাহলে আমার কিছু করার নেই।’
কোনো রাজনৈতিক দল নয়, দেশের তরুণ প্রজন্ম এবার বিপ্লব করেছে উল্লেখ করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দে হ্যাভ গিভেন দেয়ার লাইভস (তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়েছেন), যেটা আপনারা কোনো দিন দিতে পারতেন না। পুলিশের গুলি খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের কোনো দুঃখ নেই। তাঁরা (তরুণ) আপনাদের (প্রতিবিপ্লবকারীদের) মোকাবিলা করবেন। অনুরোধ করছি, দয়া করে দেশকে স্বাধীন রাখেন।’
৭ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমা দিতে হবে
বেসামরিক মানুষের হাতে নিষিদ্ধ ৭.৬২ এমএম রাইফেল পাওয়া গেছে উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, যেটা বেসামরিক মানুষের হাতে যাওয়ার কথা নয়। সেটার বৈধতা পুলিশ ও র্যাবকে দেওয়া হয়েছিল। সেই অস্ত্র কীভাবে সাধারণ মানুষের হাতে গেল?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যাঁদের হাতে অবৈধ অস্ত্র আছে, তা তাঁরা সাত দিনের মধ্যে থানায় জমা দেবেন। যদি জমা না দেন, তাহলে দুইটা চার্জ লাগবে। একটা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র, আরেকটা হচ্ছে সরকারি নিষিদ্ধ অস্ত্র আপনাদের হাতে। সেটার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতেও যাওয়া যেতে পারে যে এটা কোথা থেকে পেয়েছেন। এসব রাইফেল ফেরত দিতে হবে সাত দিনের মধ্যে। আগামী সোমবারের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। তা না হলে অস্ত্র হাতে কাউকে পেলে তাঁর বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ আনা হবে। থানায় জমা দিন। নিজেরা না দিলেও অন্যের মাধ্যমে দিন। যেভাবেই হোক, রাইফেলগুলো ফেরত দিতে হবে। না হলে আমরা অনুসন্ধান শুরু করব।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমাদের সাহায্য চাইতে হবে যে এই ঘটনা কেন ঘটল বাংলাদেশে! আমি ইতিমধ্যে অনুমোদন দিয়েছি। সামনে যে মিটিং হবে, সেখানে বলব যে কীভাবে, কারা হুকুমদাতা, কেন হয়েছেন?’
কোনো গণমাধ্যম বন্ধ করার পক্ষে নন বলেও উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমি গতকাল একটা কথা বলেছি। সে জন্য দুঃখিত। রাগের মাথায় বলেছি যে আবার চাটুকারিতা করলে বন্ধ করে দেব। এটা আমার কাজ নয়।’
সব পুলিশ সদস্য খারাপ নন বলেও উল্লেখ করেন এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, তাঁদের উপলব্ধি হয়েছে। তাঁরা নিজেরাই এখন আগের পোশাক পরে আসতে চান না। অপরাধগুলো তাঁরা করেননি, তাঁদের দিয়ে করানো হয়েছে।
‘গন্ডগোল পাকিয়ে লাভ হবে না, লোকজন আবার খেপে উঠবে’
সোমবার সচিবালয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে দেখা করে। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সরকার থেকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নিয়েও বিভিন্ন কথা বলেন এম সাখাওয়াত হোসেন । তিনি এ সময় নতুন মুখ ও নতুন অঙ্গীকার নিয়ে দল গোছাতে আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে ভালো ভালো নেতা আছেন। এই দল একসময় মধ্যবিত্তের সেক্যুলার দল ছিল। মুসলিম লীগ ছিল উচ্চবিত্তের। মধ্যবিত্তের দল ছিল আওয়ামী লীগ। এত বড় মানুষের দলের নেতা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) এ দেশ স্বাধীন করেছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তাঁর নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীনতা হয়েছে। সেই দল এভাবে ভেঙে পড়ে যাবে যে নেতাকর্মীদের লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে!
নতুন নেতৃত্বে দল গোছানোর পরামর্শ দিয়ে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আপনারা দল গুছিয়ে নিন, আপনাদের দলকে তো কেউ নিষিদ্ধ করেনি। যেকোনো দল নিষিদ্ধ করা বাজে সংস্কৃতি।’
আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়া শেখ হাসিনার উদ্দেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, 'আপনি আসবেন, আপনার দেশ। আপনি আসেন না কেন? নাগরিকত্ব তো যায়নি। ২১ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। আপনি স্বেচ্ছায় চলে গেছেন, কেউ তো যেতে বলেননি। স্বেচ্ছায় আসেন, ভালো থাকবেন, আবার আসবেন। আমরা সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু গন্ডগোল পাকিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং লোকজন আবার খেপে উঠবে।’
এ সময় জাতীয় পার্টির উদাহরণ তুলে ধরেন এম সাখাওয়াত হোসেন। এইচ এম এরশাদ কারাগারে যাওয়ায় দলটি বেঁচে যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন সংঘাত বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের এলাকা ঠিক করুন। যদি সংসদীয় এলাকা অনুযায়ী হিসাব নিতে থাকি, আপনারা আমাকে ভালো করে জানেন। আমি নতুন লোক নই। আমি নিশ্চিত করব, (সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায়) নির্বাচন যাতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দয়া করে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবেন না। ইনক্লুডিং সদ্য যে পার্টি (আওয়ামী লীগ), আপনারা দল গোছান, আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আপনাদের সাহায্য করব। আপনারা গোছান নতুন মুখ (নতুন নেতৃত্ব), নতুন অঙ্গীকার নিয়ে। আশা করি, রাজনৈতিক দল আইন অনুযায়ী হবে।’
এনডিটিভিবিডি/১২আগস্ট/এএ