ডেস্ক রিপোর্ট: দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে ১২টি সংসদ নির্বাচন হলেও এর বেশিরভাগই ছিল বিতর্কিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া চারটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বাকি সবকটি নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত শেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর প্রথমটি ‘একতরফা’, দ্বিতীয়টি ‘রাতের ভোট’ আবার সর্বশেষটি ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচনের তকমা পায়। নির্বাচনের নামে তামাশার এসব ভোটের মহড়ায় প্রায় দেড় যুগ ধরে নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন দেশের নাগরিকরা। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোও বাদ যায়নি এমন ‘নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং’ থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তুত করছে। এ মাসের শেষ অথবা আগামী মাসের প্রথম দিকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এসব সুপারিশ পেশ করা হবে। সংস্কার কমিশন সূত্রে জানা গেছে, অংশীজনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রায় সব বৈঠকেই স্থান পেয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ইস্যু। বিতর্কিত ও কলঙ্কিত এসব নির্বাচনের জন্য দলীয় সরকারের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়। সেজন্য বিগত তিনটি কমিশনের বিচারের পাশাপাশি ভবিষ্যতে কোনো কমিশন এসব অপকর্মে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করতে যাচ্ছে ইসি সংস্কার কমিশন। সর্বশেষ নাসির উদ্দীন কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন-সংক্রান্ত অনেক অপরাধ হয়েছে। এটার বিচার হওয়া দরকার। যারা অপরাধ করেছে এবং যাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা চালু, সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, নারী আসনে সরাসরি ভোট, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়া, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতির বিলোপ এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে ভারসাম্য আনাসহ অন্তত ২০টি বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশ করতে যাচ্ছে ড. বদিউল আলম মজুমদার কমিশন। এর মধ্যে অনেক সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিটিতেও থাকতে পারে। ইসি সংস্কার কমিশন গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত করা অন্তত ৩০টি বৈঠকের মতামত ও প্রস্তাবনার আলোকে এসব সুপারিশমালা তৈরি করা হচ্ছে। এসব বৈঠকের মধ্য দিয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, নারী প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতামত নেয় কমিশন। এ ছাড়া অনলাইনে এবং সরাসরি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের মতামতও নেওয়া হয়। কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে এএমএম নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে।
কমিশনের একাধিক সদস্য জানান, আগামীতে জাতীয় এবং স্থানীয় সব নির্বাচনেই ‘না’ ভোটের বিধান চালুর সুপারিশ করবে কমিশন। এটি চালু হলে নির্বাচনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোটার অংশগ্রহণ বাড়বে বলে ধারণা কমিশনের সদস্যদের। এ ছাড়া ‘না’ ভোট চালু হলে একক প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়ার সুযোগও বন্ধ হয়ে যাবে। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের প্রার্থী দেওয়ার প্রবণতাও বাড়বে। এতে ইচ্ছামতো অজনপ্রিয় ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রার্থী করে জয়ী করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ইভিএম পদ্ধতি চালুর পর থেকেই ভোট ম্যানিপুলেট করাসহ নানা অভিযোগ আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে। ভোট প্রদান করতে গিয়ে কারিগরি ত্রুটিতেও ভোগান্তিতে পড়েন ভোটাররা। ইভিএমের মাধ্যমে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা গচ্চা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ইভিএম বাতিল করে ব্যালটেই ভোট গ্রহণের সুপারিশ করতে যাচ্ছে কমিশন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দিয়ে প্রার্থীকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটি রোধ করে দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে প্রার্থীকে তৃণমূল পর্যায় থেকে মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে।
ভোটার তালিকা নিয়ে বিভিন্ন নির্বাচনে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। ভুয়া ভোটার, জাল ভোট, রোহিঙ্গা ভোটার এবং একই ব্যক্তির একাধিক ভোটার হওয়ার মতো নানা অভিযোগের তথ্য আসে। ফলে স্বচ্ছ ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নে গুরুত্ব দিয়ে সুপারিশ করবে কমিশন।
বিগত দিনে নিজেদের দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে ইচ্ছামতো সীমানা নির্ধারণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। এতে নিজ দলীয় প্রার্থীদের জয়ের পথ সুগম করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে নির্বাচনী আসনগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাবনা রাখা হচ্ছে সুপারিশে।
সূত্র জানায়, একতরফা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভোট বন্ধ করতে সুপারিশ করছে কমিশন। বর্তমানে কত শতাংশ ভোট পড়লে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, তার কোনো মান নির্ধারণ করা নেই। ফলে এক শতাংশ ভোট পেলেও আইন অনুযায়ী তাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ভোটারের অংশবিহীন এমন নির্বাচন বন্ধে জয়ের জন্য ভোট পড়ার ন্যূনতম একটি হার নির্ধারণ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে। তবে ওই হার কত শতাংশ, তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
এ ছাড়া অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, ভোটে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করতে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত করা; নির্বাচন এবং প্রার্থিতা বাতিলে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো; প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত এবং পোস্টাল ব্যালট কার্যকর করার সুপারিশ করা; নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন অডিট করা; হলফনামার তথ্য যাচাই করা; নির্বাচনী অভিযোগ দাখিল ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা; নির্বাচনী মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেঁধে দেওয়া ও ইসির ভূমিকা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত বিধিবিধান সংস্কার করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে সুপারিশমালায়।
সূত্র আরও জানায়, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অন্যতম আলোচিত ইস্যু ছিল রাজনৈতিক নেতাদের ‘ডিগবাজি’। অন্য দল থেকে ধরে এনে প্রার্থী করা হয় ক্ষমতাসীন দলের ‘মার্ক’ দিয়ে। এটি বন্ধ করতে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের নিজ দলে অন্তত তিন বছর সদস্য হিসেবে থাকার বিধিবিধান যুক্ত করতে সুপারিশ করবে বদিউল আলম মজুমদারের সংস্কার কমিশন। এ বিধান যুক্ত হলে নির্বাচনে এক দলের মনোনয়ন না পেয়ে আরেক দলে যোগ দিয়েই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বন্ধ হবে। এতে মনোনয়ন কেনাবেচায় টাকার খেলাও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নিজেদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা। জনগণের সেই অধিকার ফিরিয়ে এনে নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে আমরা একগুচ্ছ সুপারিশ করব। এসব সুপারিশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এবং অংশীজনের মধ্য থেকেই পাওয়া। তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যেসব মতামত উঠে এসেছে, তার আলোকেই এসব সুপারিশ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, সংসদের উচ্চকক্ষের প্রবর্তন এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকারসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো কেন সুন্দর ও নিরপেক্ষ ছিল। কারণ তারা নির্বাচনের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করেনি। সেজন্য আমাদের সুপারিশের অন্য বিষয় হবে এ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা।’
বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, ‘না ভোটের পক্ষে অনেক জনমত আছে। না ভোট থাকলে ২০১৪ সালের কলঙ্কজনক নির্বাচন হতো না। ১৫৩ জন বিনাভোটে নির্বাচিত হতে পারত না। না ভোট যদি আসে, তাহলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। সেজন্য আমরা এটি সুপারিশ করব। এ ছাড়া দেড় থেকে দুই কোটি প্রবাসী রয়েছে। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে আমরা সুপারিশ করব।’
আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত করার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ড. শামসুল হুদার কমিশনের সময় এ নিয়ে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা দেখেছি। সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় আনা—এসব বিষয় বিবেচনাধীন।’ নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন কমিশন প্রধান।
এনডিটিভি/এলএ