নিজের কথা বলতে সবাই পছন্দ করে। তবে অন্যেকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিরক্তিকরভাবে সারাক্ষণ নিজের কথা বলাও অভদ্রতার লক্ষণ।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘কনভার্সেশনল নার্সিসিজম’।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক মনোবিজ্ঞানি ড. ব্রায়ান টির্নি এই বিষয়ে বলেন, “একজন ‘কনর্ভাসেশনাল নার্সিসিস্ট’ সারাক্ষণ অতি মাত্রায় নিজের কথা বলে; যে কোনো আলাপচারিতায় নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার চেষ্টা করে।”
‘নার্সিসিজম পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (এনপিডি)’ মানসিক সমস্যার ধরন হিসেবে ধরা হলেও এই ‘আমিত্ব’ ঝরানোর সাথে মানসিক রোগের কোনো লক্ষণ নয়; বরং এটা হল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
“এটা আসলে ব্যক্তির চরিত্রের একটা ধরন, কোনো মানসিক সমস্যা নয়”- একটি প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিলভার হিল হসপিটাল’য়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. বেন বার্নস্টেইন।
‘কনভার্সেশনল নার্সিসিজম’ এবং ‘এনপিডি’র মধ্যে প্রধান কিছু পার্থক্য রয়েছে। ‘এনপিডি’র জন্য নয়টি বৈশিষ্ট্য খেয়াল করা হয়। তবে ‘কনভার্সেশনল নার্সিসিজম’য়ের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়।
যখন অন্যদের সাথে কথা বলে তখন স্বাভাবিকভাবে নিজের দিকে নজর ফেরানোর চেষ্টা করে যায়।
ডা. টির্নি বলেন, “‘কনভার্সেশনল নার্সিসিজম’ নিজের সম্পর্কে প্রচুর কথা বলে যায়। যদি থেরাপি নিতে যায় তবে কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই এরা নিজের সম্পর্কে বলে যেতে থাকে।”
বিভিন্নভাবে ‘কনভার্সেশনল নার্সিসিজম’য়ে ভোগা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা যায়। যেমন-
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে অবস্থিত ‘থ্রাইভওয়ার্কস কাউন্সেলিং অ্যান্ড সাইকিয়েট্রি টাম্পা’র সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কেট ড্যানলি বলেন, “ওপরের বৈশিষ্ট্যগুলো কারও মাঝে একক বা সমষ্টিগতভাবে থাকতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “মনে রাখতে হবে তাদের এসব বৈশিষ্ট্যগুলো যে ক্ষতিকর বা ভুল সেটা তারা বুঝতেও পারে না; চিন্তাতেও আসে না।”
তাদের মনোভাবটা কী থাকে?
ড্যানলি বলেন, “নিজের সম্পর্কে জাহির করার জন্য ‘কনভার্সেশনল নার্সিসিস্ট’র প্রথমে অন্যকে প্রশ্ন করে কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করায়। একটু পরেই কথার মোড় ঘুরিয়ে নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করে।”
অন্যান্য নার্সিসিস্টদের মতো এদের একমাত্র উদ্দেশ্যই থাকেন ‘নিজের প্রতি নজর’ ফেরানো।
যে কারণে এরকম করে
“সাধারণভাবে নিজের অহংবোধ বাড়াতে গিয়ে এই ধরনের ব্যবহার দিয়ে থাকেন তারা”- বলেন ড্যানলি।
তবে সবক্ষেত্রে নয়। অনেকে কোনো বিষয় না জানার কারণে যে চাপ বোধ করে সেটা ঢেকে রাখতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে বেশি কথা বলা বা অন্য কোনো জানা বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করে।
তিনি আরও বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকেও এরকম হয়। যেমন- চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনের সময়ে কোনো শিশুর চাহিদা পূর্ণ না হলে এক পর্যায়ে সে ‘কনভার্সেশনল নার্সিসিস্ট’ হয়ে যেতে পারে।”
সম্পর্কে প্রভাব
‘কনভার্সেশনল নার্সিসিস্ট’রা সাধারণত দ্রুত নির্ভশীলতার সম্পর্ক গড়তে পারে- মন্তব্য করেন ডা. টির্নি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “সম্পর্কে যে প্রদানকারী সে ভক্তি অর্জনের জন্য ভোগকারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। আর যে ভোগকারী সে প্রদানকারীকে ধরে রাখে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য।”
এই ধরনের সম্পর্কের বিষয়ে শুনতে রূপকথার মতো মনে হলও একসময় ভাঙন দেখা দেয়। হয় নার্সিসিস্ট সঙ্গী এক পর্যায়ে নতুন শ্রোতা খোঁজা শুরু করে নয়তো অন্যজন আসল অন্তরঙ্গতার খোঁজে নেমে যায়।”
ড্যানলি এই বিষয়ে আরও নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরে বলেন, “‘কনভার্সেশনল নার্সিসিস্ট’ সাধারণত সঙ্গীর কথা ঠিকমতো বা ভালোমতো শুনে না। এই ধরনের আচরণ সম্পর্কে হতাশা তৈরি করে।”
তাছাড়া সামাজিক দিক থেকেও ক্ষতি বয়ে আনে। মানুষ যখন এই ধরনের ব্যক্তির থেকে মুখ ফেরায় তখন তার সঙ্গীকে-সহ এড়ায়। ফলে সেই দম্পতি নিজেদের সামাজিকভাবে বিছিন্ন অনুভব করা শুরু করে।
‘কনভার্সেশনল নার্সিসিস্ট’দের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর পন্থা
কথার মোড় ঘোরানো: এই ক্ষেত্রে নিজের দিকে কথার মোড় ঘোরানো বাজে কোনো বিষয় না। যেমন- তারা যদি ছুটির দিনে কী করেছে- সে বিষয়ে বলতেই থাকে, তবে কথার মাঝখানে ‘কি দারুণ’ কথাটার পর ‘আমি কী করেছি শুন’ বলে কথার ধারা নিজের দিকে ফেরানো যেতে পারে।
স্পষ্টবাদী ও সরাসারি বলা: কথার মোড় ঘোরানো না গেল এই পন্থা অনুসরণে কাজ হওয়া সম্ভব। যেমন- জোর দিয়ে বলা যেতে পারে, ‘এইখানে আমি একটা কথা বলি’। প্রাথমিকভাবে ‘শক’ খেয়ে সেই ব্যক্তি কথা থামিয়ে দেবে।
‘গ্রে রক’ পন্থা অবলম্বন: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘কনভার্সেশনল নার্সিসিস্ট’ অন্যের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আশা করে। সেটা যদি না দেওয়া হয় তবে তারা আগ্রহ হারিয়ে অন্যদিকে চলে যাবে।
পরিকল্পনা করা বা ফন্দি আঁটা: কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না! তাহলে ওই ব্যক্তিকে বলুন আপনার হাতে সময় কম। অন্য কাজ আছে। খুব বেশি হলে তিন মিনিট কথা শোনার সময় হতে পারে।
সীমারেখা টানা: কাজটা কঠিন হলেও গুরুত্বপূর্ণ। ড্যানলি পরামর্শ দেন- জানিয়ে দিন আপনাকে গুরুত্ব দিলেই তাদেরকে গুরুত্ব দেবেন। তারপরও সেটা না করলে কথাবর্তা শেষ করে দিতে পারেন।
কখন সরে আসতে হবে সেটা জানা: যদি ইতিবাচক কোনো সাড়া না মেলে সেক্ষেত্রে নিজেকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। যদি মনে হয় ‘চেপে বসছে’ বা সম্পর্কে অতিরিক্তি দিতে হচ্ছে তবে সেখান থেকে সরে আসাই হবে যুক্তিযুক্ত।
ডা. টির্নি বলেন, “তার মানে এই না, আপনি ‘খারাপ’ মানুষ। সম্পর্কে নিজের ‘স্পেস’ বা স্থান থাকতে হবে। অনেকসময় প্রচেষ্টার মূল্য পাওয়া যায় না। এই সময়ে সেরাটা হল কথোপকথন থেকে বের হওয়ে যাওয়া।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো, নিজের প্রতি আত্মমর্যাদা ও যত্নশীল হতে হবে। যেসব প্রিয়জনদের বিশ্বাস করেন তাদের ওপর ভরসা রাখুন। পর্যাপ্ত ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আর এমন শখগুলো পূরণ করার চেষ্টা করুন যেটা আপনাকে ভালো অনুভূতি দেবে।
একজন ‘কনভার্সসেশনাল নার্সিসিস্ট’কে মোকাবিলা করা ক্লান্তিকর আর কঠিন হতে পারে। সেখানে হয়ত নিজেকে শক্তিহীন মনে হবে। মনে রাখতে হবে- নিজে কী বোধ করবেন সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর্ক করে নিজেকে কীভাবে সামলাচ্ছেন।
এনডিটিভি/পিআর