ডেস্ক রিপোর্ট: মৃত চাচাকে বানিয়েছেন বাবা। নিখোঁজ চাচিকে বানিয়েছেন মা। জন্মসনদ থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের সব জায়গায় বাবা-মায়ের জায়গায় ব্যবহার করেছেন চাচা-চাচির নাম। কারণ একটাই—ওই চাচা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটার সুবিধা নিতে এমন প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন একজন স্কুলশিক্ষক। শাহ আমানউল্লাহ। তিনি তার ছেলের জন্য এমন করেছেন।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বাসিন্দা এই পরিবার। স্কুলশিক্ষক শাহ আমানউল্লাহ নিজের ছেলেকে ভাইয়ের সন্তান বানিয়েই থেমে থাকেননি, বড় ভাইয়ের মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকাও আত্মসাৎ করছেন।
বর্তমান চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে দিয়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারও কঠোরভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাই করছে। এমন পরিস্থিতিতে ধরা পড়ার ভয়ে সম্প্রতি জন্মসনদসহ সব শিক্ষা সনদ থেকে চাচা-চাচিকে বাদ দিয়ে প্রকৃত বাবা-মায়ের নাম লিখিয়ে সংশোধন করিয়েছেন।
বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তনের খোঁজ পাওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করে কালবেলা। এ জন্য সজীবের শিক্ষাজীবনের সব প্রতিষ্ঠান থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করেন প্রতিবেদক। নথি ঘেঁটে প্রতারণার সত্যতা মেলে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সজীবের বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার বরনাল ইউনিয়নের বিলদুড়িয়া গ্রামে। জন্মসনদ, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ-এমএ পরীক্ষা সংক্রান্ত দলিলপত্রে দেখা যায়, সজীবের বাবার নাম এফ এম মশিউর রহমান এবং মায়ের নাম সুলতানা পারভীন। এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রেও মশিউর রহমান এবং সুলতানা পারভীন তার পিতা-মাতা।
অনুসন্ধান বলছে, এফ এম মশিউর রহমান রাষ্ট্র স্বীকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার বর্তমান স্ত্রীর নাম ফাতিমা বেগম এবং তার একমাত্র সন্তানের নাম ফারহানা। এই একটি মেয়েসন্তান ছাড়া তার কোনো ছেলেসন্তান নেই। তিনি সজীবের বড় চাচা এবং সুলতানা পারভীন এই চাচার সাবেক স্ত্রী (তালাকপ্রাপ্ত)।
চাচা-চাচি কীভাবে বাবা-মা হলেন—এ তথ্য যাচাই করতে সজীবের গ্রামের বাড়ি যান কালবেলা প্রতিবেদক। সেখান থেকে জানা যায়, সজীবের জন্মদাতা বাবার নাম শাহ আমানউল্লাহ এবং মাতার নাম শারমিন আক্তার বিউটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সজীবের বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান ২০১১ সালে মারা যান। প্রতারণার শুরুটা হয় তার মৃত্যুর পর সজীবকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির সময়। স্কুলে ভর্তির জন্য নিজের ছেলেকে বড় ভাইয়ের সন্তান বানিয়ে এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর জাল করে জন্মসনদ বানান শাহ আমানউল্লাহ।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১২ সালে নিজ জেলার বাইরে গিয়ে যশোরের সম্মিলনী স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন সজীব। সেখান থেকে ২০১২ সালে জেএসসি এবং ২০১৫ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি। ওই স্কুলের নথিতে দেখা যায়, সজীবের বাবার নাম মশিউর রহমান (প্রকৃতপক্ষে চাচা) এবং মায়ের নাম সুলতানা বেগম (প্রকৃতপক্ষে চাচি)। এসএসসি পাস করার পর ২০১৫-১৬ সেশনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হন সজীব। ওই কলেজ থেকে এইচএসএসসি পাস করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে কোটায় ভর্তি হন সজীব।
এইচএসসি পাসের পর ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন সজীব। ভর্তির আবেদন ফরমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উল্লেখ করে কোটায় আবেদন করেন। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন এবং স্নাতক সম্পন্ন করেন। সেখানেও পিতা-মাতার ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষে ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদন ফরমেও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উল্লেখ করেন সজীব।
সম্প্রতি জন্মসনদ থেকে শুরু করে সব শিক্ষা সনদে বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তিত এসব কপি কালবেলার হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাবার নামের জায়গায় এফ এম মশিউর রহমানের পরিবর্তে প্রকৃত বাবা শাহ আমানউল্লাহ লেখা হয়েছে। একইভাবে সুলতানা পারভীনের পরিবর্তে প্রকৃত মা শারমিন আক্তার বিউটি লেখা হয়েছে।
অর্থাৎ প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে বাবা বানিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর প্রকৃত বাবার পরিচয় ব্যবহার করতে চাচ্ছেন সজীব। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যশোর শিক্ষা বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত নাম পরিবর্তন করার পর অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে নাম পরিবর্তন করে নিয়েছেন সজীব।
প্রতারণার বিষয়ে শাহ আবু সুফিয়ান সজীব বলেন, মশিউর রাহমান আমার চাচা, আমার বাবার নাম শাহ আমানউল্লাহ। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় ভুল করে বাবার নামের জায়গায় চাচার নাম লেখা হয়েছিল। কেন এটা হয়েছিল, সেটা আমার জানা নেই। তবে এখন সংশোধন করা হয়েছে।
এতদিন পর কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার প্রকৃত বাবার পরিচয় ব্যবহার করতে চাই। তাই নাম সংশোধন করেছি। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটা ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু সার্টিফিকেটে চাচার নাম রয়েছে, এ নিয়ে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়, সেজন্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উল্লেখ করা হয়েছিল।
সজীবের প্রকৃত বাবা শাহ আমানউল্লাহর কাছে জানতে চাইলে অদ্ভুত উত্তর দেন তিনি। শাহ আমানউল্লাহ বলেন, অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির সময় ভুল হয়েছিল, সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু চাচা-চাচি কীভাবে বাবা-মা হলেন—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলেন, সজীবকে তার বড় চাচা বেশি আদর করতেন এবং এই চাচা তখন যশোর থাকতেন। সেজন্য স্কুলে ভর্তির সময় তার পরিচয় ব্যবহার করা হয়।
সজীবের চাচার মৃত্যুর পর কীভাবে জন্মসনদ তৈরি করা হলো—এ প্রশ্নের জবাবে শাহ আমানউল্লাহ বলেন, স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মসনদ প্রয়োজন হয়। সে হিসেবেই জন্মসনদ তৈরি করা হয়। তখন ভুল হয়েছিল। এজন্য এখন নাম পরিবর্তন করে জন্মসনদ সংশোধন করা হয়েছে।
জন্মসনদে বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে বরনাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াররম্যান মো. মনিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন আমি চেয়ারম্যান ছিলাম; কিন্তু চাচাকে বাবা বানিয়ে জন্মসনদের বিষয়ে আমার জানা নেই। পরে তার সই করা জন্মসনদের কপি দেখালে তিনি বলেন, এটা আমার স্বাক্ষর নয়, আমার স্বাক্ষর জাল করে এ সনদ তৈরি করা হয়েছে। আর সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে সজীবের বাবা আমার কাছে এসেছিলেন তার ছেলের জাতীয় পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধনের প্রত্যয়নপত্র নিতে। সেই হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছি। কিন্তু তারা যে আগেও বাবার নাম পরিবর্তন করে জন্মসনদ তৈরি করেছিলেন, সে তথ্য আমার কাছে গোপন করেছেন।
অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই প্রতারণা এবং জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণত ছোটখাটো ভুল থাকলে আবেদনকারীর প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য নিয়ে নাম সংশোধন করে দেওয়া হয়। কিন্তু নাম পরিবর্তনের মতো সংশোধনের প্রয়োজন হলে প্রশাসনিক তদন্ত করা হয়। সজীবের বেলায় সেটা করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন জালিয়াতির পরও নাম পরিবর্তনের সুযোগ করে দেওয়ার পেছনে অন্যদের যোগসাজশ থাকতে পারে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে নাম পরিবর্তনের আবেদন সংশোধন করা হয়েছে, যদিও তারা বিষয়টি জানার পর প্রতারণা হিসেবেই মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ বলেন, শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীর তথ্য সংশোধন করে দেওয়া হয়। সজীবের বেলায়ও তাই হয়েছে। যদি প্রতারণা হয়ে থাকে তাহলে আগে হয়েছে, সেটা আমাদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তন করা অবশ্যই প্রতারণা। এ ধরনের কেস আমাদের কাছে এটাই প্রথম। তাই আসলে কী ঘটেছে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তার সব তথ্য আমরা যাচাই-বাছাই করব। প্রতারণা প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম পরিবর্তনের বিষয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিবের সঙ্গে কথা হয় কালবেলা প্রতিবেদকের। সবকিছু শুনে এবং সজীবের তথ্য দেখে তারা বলেন, প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়েই সংশোধন করা হয়েছে। সাধারণত নাম পরিবর্তনের মতো জটিল বিষয়গুলোয় তদন্ত করা হয়, কিন্তু সজীবের বিষয়ে কেন তদন্ত হয়নি সেটা খতিয়ে দেখা হবে। সজীবের বিষয়টি প্রতারণা হয়েছে উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু নিজের ছেলেকে বড় ভাইয়ের সন্তান বানিয়েই ক্ষান্ত হননি শাহ আমানউল্লাহ, বড় ভাইয়ের মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকাও নিয়মিত আত্মসাৎ করছেন। নথি ঘেঁটে জানা যায়, এফ এম মশিউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রতি মাসে তার নামে ২০ হাজার টাকা ভাতা দেয় সরকার। মশিউর রহমানের মৃত্যুর পর ভাতা আসে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ফাতিমা বেগমের নামে। প্রতি মাসে ভাতার টাকা তুলতে ফাতিমাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে যান শাহ আমানউল্লাহ। টাকা তোলার পর মাত্র সাড়ে ৭ হাজার টাকা দেন ফাতিমাকে। বাকি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নেন শাহ আমানউল্লাহ। সেই হিসেবে গত ১২ বছরে প্রায় ১৮ লাখ টাকা নিয়েছেন শাহ আমানউল্লাহ; কিন্তু ফাতিমা ভয়ে কাউকে কিছু বলেন না। কারণ ভাতার বই থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধার সব সনদ শাহ আমানউল্লাহ নিয়ে রেখেছেন বলে ফাতিমার অভিযোগ।
এ বিষয়ে শাহ আমানউল্লাহ বলেন, বড় ভাবি খুশি হয়ে আমাকে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দেন। তাকে বাধ্য করে টাকা নেওয়া হয় না। বিষয়টি কালিয়ার ইউএনও মো. রাশেদুজ্জামানকে জানানো হলে তিনি বলেন, বিষয়টি এরই মধ্যে আমি অবগত হয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনডিটিভি/এলএ