নিজস্ব প্রতিবেদক : র্যাবের বিরুদ্ধে গুম, খুন, অপহরণসহ বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত র্যাব দ্বারা নির্যাতিত ও সাত খুনসহ যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের পরিবার ও স্বজনদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি তদন্ত ও বিচারেই র্যাবের দায়মুক্তি সম্ভব। অন্য কোনো উপায়ে দায়মুক্তি সম্ভব না। আমরা বিচারের ভিত্তিতেই দায়মুক্তি চাই।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এসময় র্যাব ডিজি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে। আমি আপনাদের (গণমাধ্যম) ও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, র্যাব তার দায়িত্ব আন্তরিকতা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবে।
তিনি বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে গুম, খুন, অপহরণসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। সৃষ্টির পর থেকে এখন পর্যন্ত র্যাব দ্বারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের পরিবার ও স্বজনদের কাছে আমরা দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। এসমস্ত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করছি। অন্তর্র্বতী সরকার গুম খুন কমিশন গঠন করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ সংক্রান্ত অভিযোগের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আমরা আশা করবো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত ও অবিচার হবে। আমরা মনে করি তদন্ত ও বিচারেই র্যাবের দায়মুক্তি সম্ভব। অন্য কোনো উপায়ে দায়মুক্তি সম্ভব না।
বক্তব্যের শুরুতেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। গত জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন এবং যারা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসারত আছেন তাদের সুস্থতা কামনা করেন।
তিনি আরও বলেন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে ২০০৪ সালের জন্মলগ্ন থেকে চরমপন্থি, জলদস্যু ও সন্ত্রাস দমন, মাদকবিরোধী কার্যক্রম, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, কিশোর গ্যাং নির্মূল, সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেপ্তারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত্র ব্যবসায়ী, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে র্যাব নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫০০ এর অধিক আসামি গ্রেফতার এবং ২০ হাজারের অধিক বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠা থেকে এ পর্যন্ত আনুমানিক ৬ হাজার ২৯২ কোটি ৫ লাখ টাকা মূল্য মানের মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ দেড় লাখ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে ২৩টির বেশি মামলার আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজধানীর পিচ্চি হান্নান, টেকনাফের নয়াপাড়ার সন্ত্রাসী জকির, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লম্বু মোশারফ, শীর্ষ সন্ত্রাসী কবির, ডাকাত শহীদ, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাকিল মাজাহার, হত্যা ও অপহরণ মামলাসহ মোট ১৫টি মামলার আসামি খোকনসহ দেশের তালিকাভুক্ত বেশ কয়েক জন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে র্যাব।
র্যাবের তত্ত্বাবধানে ২০২৩ সালের ২১ মে দেশের বিভিন্ন জেলার ৩১৪ জন চরমপন্থির সদস্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে।
আত্মসমর্পণকৃত চরমপন্থি সদস্য ও তাদের পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি ‘উদয়ের পথে’ নামক পাইলট প্রোগ্রামের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে র্যাব।
সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে র্যাবের টানা অভিযানের ফলে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন জলদস্যু বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করায় গত ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু ও তাদের পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি সুন্দরবনের হাসি নামক প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সুন্দরবনের দুবলার চরে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করেছে র্যাব।
র্যাবের মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে এ পর্যন্ত ২৭ হাজার ১৪৭টি অভিযানে ৪৮ হাজার ৩২২টি মামলা দায়ের করা হয় এবং ২৯০ কোটি ২১ লাখ টাকার অধিক অর্থ দণ্ড আদায় করা হয়। এছাড়াও ২৬ হাজার ৩২৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত সাড়ে ৬ হাজারের অধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার ছাড়াও র্যাবের নিয়মিত অভিযানে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অপহরণ ও প্রতারণার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩৪ হাজার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি দায়িত্ব পালনকালে র্যাব ফোর্সেসের ৩৫ সদস্য শহীদ হয়েছে এবং সহস্রাধিক র্যাব সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
বিভিন্ন অপরাধে দেশব্যাপী র্যাব কর্তৃক প্রায় ১ লাখ মামলা করা হয়েছে। এছাড়াও র্যাব ফোর্সেস কর্তৃক এ পর্যন্ত তদন্তকৃত ও তদন্তাধীন ২ হাজার ৫০০টি মামলা রয়েছে।
র্যাব সদস্যদের শাস্তির পরিসংখ্যান
বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমি কর্মকর্তাসহ সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সব ক্ষেত্রে আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনুসরণ করবো। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনও ঘটনা ঘটলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতিষ্ঠা থেকে আজ পর্যন্ত র্যাব ফোর্সেসের ৫৮ জন কর্মকর্তাসহ ৪ হাজার ২৩৫ জন র্যাব সদস্যকে শৃঙ্খলা বহির্ভূত কার্যক্রমের জন্য লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
৫ আগস্ট পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার ওপর হামলা, হত্যা ও হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে এবং নাশকতার নেতৃস্থানীয় যাদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জন সাবেক মন্ত্রী, ১৭ জন সাবেক এমপি, সাবেক মেয়র, উপজেলা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ৪০ জন, কাউন্সিলর ও মেম্বার ১৬ জন, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ১৮৩ জন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনার মাধ্যমে চিহ্নিত করে ৩০ জন সরাসরি গুলিবর্ষণকারীসহ সর্বমোট ৩৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় র্যাবের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে ৯০টি অস্ত্র ও ৭ হাজার ৩০৩ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
তিনি জানান, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে লুণ্ঠিত ২২৮টি অস্ত্র ও ১১৯৪১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও ৫ আগস্ট পরবর্তী দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ৮০ জন অপরাধীকে গ্রেপ্তার, ১৫০টি অস্ত্র ও ১ হাজার ২৯ রাউন্ড গোলাবারুদসহ সর্বমোট ৪৬৮টি অস্ত্র ও ২০ হাজার ২৭৩ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করে র্যাব।
জুলাই বিপ্লবের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ হাজর ২৩৮ জন মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জব্দ করা হয় ৭ লাখ ৫১ হাজার ২৯০টি ইয়াবা, ২৮.৬ কেজি হেরোইন, ৫৮ হাজার ৪৭৬ বোতল ফেনসিডিল, ৫ হাজার ৫২১ কেজি গাঁজা, ৪ হাজার ৮৩৬ বোতল বিদেশি মদ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পলাতক ১১০ জন এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১০৫ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে গার্মেন্টন্স সেক্টরে অস্থিতিশীল সৃষ্টিকারী ১৬ জন দুস্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে হামলাকারী ৫ জন; আনসার বিদ্রোহের মদদদাতা ২ জন ও বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী ২ জনসহ মোট ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
৫ আগস্ট পরবর্তীতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে দেশের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও কেপিআইসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রধান কার্যালয়ের নিরাপত্তা প্রদান করে র্যাব।
জুলাই বিপ্লবে আহত ও নিহতের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া র্যাব ফোর্সেস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়। পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবে আহত আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে র্যাব। এছাড়াও যারা আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা নিতে পারছিলেন না র্যাব নিজ ব্যবস্থাপনায় তাদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন র্যাব এডিজি (অপারেশনস) কর্নেল ইফতেখার আহমেদ ও পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস।
এনডিটিভিবিডি/১২ডিসেম্বর/এএ