শেখ আমিনুর হোসেন, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরা সদরের বাঁশতলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অরবিন্দু মন্ডলকে (৭৩) হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করেছেন তার ছেলে বিশ্বনাথ মন্ডল ও তার স্ত্রী কবিতা মন্ডলের বিরুদ্ধে। শনিবার সকাল ৯টার দিকে ওই স্কুল শিক্ষকের নিজ বাড়িতে এঘটনা ঘটে। নির্যাতনের ভিডিও চিত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মঙ্গলবার সকালে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পুলিশ আসার খবর শুনে নির্যাতনকারী কবিতা স্থানীয় ইউপি সদস্য সন্তোষ মণ্ডলের ছেলে সুদীপ্ত মণ্ডলের মোটর সাইকেলে পালিয়ে গেছে। ছেলে বিশ্বনাথ নিজ গ্রামে আত্মগোপন করে।
অরবিন্দু মন্ডল বাঁশতলা রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০১০ সালের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক।
নির্যাতনের স্বীকার অরবিন্দ মন্ডল জানান, ১৯৫৩ সালের ১০ জুন তিনি বাঁশতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি ঘোনা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি বাঁশতলা রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দুই ছেলের মধ্যে বিশ্বজিৎ মণ্ডল বাড়িতে থাকে। ছেটে ছেলে সঞ্জীব মণ্ডল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরে বসবাস করে। পেশাগত কারণে সে ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে মহারাষ্ট্রে থাকে। ২০১০ সালের ৯ জুন তিনি (অরবিন্দ) অবসরে যান। ক্রমশঃ তার শ্রবণ শক্তি হারিয়ে যায়। বড় মেয়ে ভারত থেকে তাকে একটি শ্রবণযন্ত্র কিনে দেন। এরপর থেকে তার ছেলে ও পুত্রবধু তাকে ভাল চোখে দেখতো না। তাকে কারণে অকারণে নির্যাতন করে আসছে। গত বছর তার স্ত্রী চপলা মণ্ডল মারা যাওয়ার পর থেকে নিজেই রান্না করে খান। ছোট ভাই সুভাষ মণ্ডল, আত্মীয় স্বজন বা প্রতিবেশীরা তাকে থেতে দিতে চাইলেও ছেলে ও পুত্রবধুর গালাগালির কারণে তিনি নিজেই রান্না করে খান। শনিবার সকালে তাকে বাড়ির উঠানে ফেলে মশারির নেট দিয়ে পুত্রবধু ও ছেলে তার হাতে ও পায়ে বেঁধে মারপিট করে। পুত্রবধু তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এ নিয়ে গত এক বছরে আটবারে তাকে মারপিট করেছে ছেলে ও পুত্রবধু। তিনি বলেন, ছেলে অরবিন্দুর দুই ছেলে রাজ পঞ্চম ম্রেণীতে পড়ে, একই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে ছোট ছেলে দ্বীপ। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাছাড়া সন্তানের বিরুদ্ধে শিক্ষক পিতা মামলা করে কিভাবে?
মেয়ে অঞ্জনা মন্ডল ও শান্ত্বনা মণ্ডল জানান, তার বাবার গচ্ছিত দেড় লাখ টাকা দুই দফায় হারিয়ে যায়। পুত্রবধু কবিতা ওই টাকা চুৃরি করেছে বলে বাবা ধারণা করে আসেন। ওই টাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য সন্তাষ মণ্ডলের কাছে সুদে খাটাচ্ছে বৌদি কবিতা বলে তারা জেনেছেন। যে কারণে সন্তোষ মণ্ডল ও তার পরিবারের সদস্যরা বাবাকে নির্যাতনে কোন বাধা দেন না। উপরন্তু বাবা এখান থেকে চলে গেলে তারা খুশী হন। আগে যে দড়ি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হওেতা সেই দড়ি বাবা অন্যত্র লুকিয়ে রাখেন । তাই শনিবার সকালে পূর্ণিমার বাড়ি থেকে মশারির নেট এসে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। বাবাকে নির্যাতনের ব্যাপারে প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা কথা বলতে গেলে বউদি কবিতার আত্মীয় খগেন্দ্র নাথ মণ্ডল, তার স্ত্রী পূর্ণিমা তেড়ে আসেন। তবে ইউপি সদস্য সন্তোষ মণ্ডলের প্রশয়ে বিশ্বানথ ও তার স্ত্রী কবিতা মঙ্গলবার সকালে গ্রামে এলেও বাড়িতে আসে বিকেল ৫টার দিকে।
বাঁশতলা উত্তর পাড়ার কয়েকজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের জানান, কবিতা মণ্ডলের সঙ্গে সন্তোষ মণ্ডলের শুধু টাকা সুদ খাটানোর সম্পর্ক না। তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর প্রেম। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হওয়ায় প্রতিবেশি ও স্বজনরা কবিতার কাছে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের পাত্র। তবে সোমবার বাড়িতে পুলিশ আসলে মেম্বরের ছেলের মটর সাইকেলে পালিয়ে যায় কবিতা। দুই ছেলে রাজ ও দ্বীপকে তারা সঙ্গে নিয়ে যায়। গ্রামে আত্মগোপন করে থাকে বিশ্বনাথ। মঙ্গলবার ভোরে বাড়িতে এসে দুই বোন ও বাবার কাছে নিজের ও স্ত্রীর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় বিশ্বনাথ। তবে এতকিছুর পরও ছেলে ও পুত্রবধুর বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না অরবিন্দু মন্ডল। তবে অরবিন্দু মণ্ডলের দুই ভাইয়ের ভারতে যাওয়ার পর তাদের ১/১ খতিয়ানে যাওয়া সম্পত্তি দখলে নিতে সন্তোষ মণ্ডল কবিতাকে কৌশলে বগলদাবা করে রেখেছে।
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য সন্তোষ মণ্ডল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে কবিতার টাকা সুদে নেওয়া বা তার সঙ্গে কোন অনৈতিক সম্পর্ক থাকার কথা সঠিক নয় উল্লেখ করে বলেন, নির্যাতনের বিষয়টি অমানবিক। এ নিয়ে কয়েকবার শালিস হয়েছে।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম বলেন, "সমাজের একটা বাস্তব অথচ নিষ্ঠুর চিত্র এটি। ভিডিওটা দেখার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয়েছিল। বর্তমান ছেলে ও তার স্ত্রী পলাতক রয়েছে। ’’
পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে জানান পুলিশ সুপার।
এনডিটিভি/এলএ