ঢাকা , রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

থাপিছু আয় বাড়লেও বৈষম্য উদ্বেগজনক

ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩
অর্থনীতি
থাপিছু আয় বাড়লেও বৈষম্য উদ্বেগজনক

দেশের প্রবৃদ্ধি, মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বাড়ার বিপরীতে আয় বৈষম্যও বাড়ছে। অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আয় বৈষম্য ছিল সবচেয়ে কম। আর ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয় বৈষম্য বাড়ছে।

আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আড়াই দশকে দক্ষিণ এশিয়ার যে তিনটি দেশে আয় বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে সেই তিনটি দেশ হলো বাংলাদেশ, ভারত শ্রীলঙ্কা। আর যে তিনটি দেশে কমেছে সেই তিনটি দেশ হলো ভুটান, মালদ্বীপ নেপাল। আইএমএফের সাউথ এশিয়াজ পাথ রেজিলিয়েন্স গ্রোথ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়।


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। ২০০০ থেকে ২০১০ সময়ের মধ্যে প্রবৃদ্ধি দ্রুত হয়। তবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয় বৈষম্যও বাড়তে থাকে। ১৯৯১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তা দ্রুত বেড়েছে।

আয়বৈষম্য মানে যে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়ছে না তা নয়। কিন্তু তাদের আয় বাড়ছে ধীরগতিতে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি হওয়ার ফল পাচ্ছে কিছুসংখ্যক মানুষ। আয়ের সিংহভাগ কিছু লোকের হাতে চলে যাচ্ছে।

. হেলালউদ্দিন, অর্থনীতিবিদ

গত বুধবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর খানা আয় জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য উদ্বেগজনহারে বেড়েছে।

বাংলাদেশে এখন গড় আয় বৈষম্যের সূচক গিনি সহগ .৪৯৯। গ্রাম এলাকায় .৪৪৬ এবং শহরাঞ্চলে .৫৩৯। গিনি সহগ হচ্ছে একটি দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিসংখ্যানগত পরিমাপ। গিনি সহগ শূন্য () সম্পূর্ণ সমতা প্রকাশ করে। আর সহগ হলে তা সম্পূর্ণ অসমতাকে প্রকাশ করে।


কোনো দেশের বৈষম্য যখন গিনি সহগ অনুযায়ী .৫০০ হয়, তখন ওই দেশটি উচ্চমাত্রার বৈষম্যে ভোগে। .৪৯৯ গিনি সহগ নিয়ে বাংলাদেশ এখন উচ্চমাত্রার বৈষম্যের কাছাকাছি রয়েছে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ .৪৮২ আর ২০১০ সালে গিনি সহগের মান ছিল .৪৫৮। অর্থাৎ, দেশে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরো কমে গেছে। এর ফলে ভোগ বৈষম্যও বাড়ছে।

আয়ের দিক থেকে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ আছে। অন্যদিকে শীর্ষ শতাংশের হাতে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ আছে।

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবেচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ।

প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়্যালিটি ল্যাব-এর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়্যালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬. শতাংশ ছিল কেবল এক শতাংশ মানুষের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের ছিল ১৭ শতাংশ।

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবেচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ।

প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়্যালিটি ল্যাব-এর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়্যালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬. শতাংশ ছিল কেবল এক শতাংশ মানুষের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হিস্যা ছিল ১৭ শতাংশ।

বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে দেশে দারিদ্র্য ছিল ২৪. শতাংশ। ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮. শতাংশে।

বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, ২০২২ সালে দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে আয় হয়েছে মাসে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। ২০১৬ সালে পরিবারপ্রতি গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। আর ২০১০ সালে পরিবারপ্রতি গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা।

জরিপের তথ্য মতে, ২০২২ সালে গড়ে পরিবারপ্রতি মাসিক ব্যয় ছিল ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৬ সালে প্রতি পরিবারে গড় মাসিক ব্যয় ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। আর ২০১০ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল পরিবারগুলো গড়ে মাসে ১১ হাজার ২০০ টাকা ব্যয় করেছিল।

সেন্টার ফর পলিসি ডয়ালগ (সিপিডি)- গবেষণা পরিচালক . খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিবিএসের জরিপই বলছে, সবচেয়ে নিম্ন আয়ের পাঁচ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের পাঁচ শতাংশের মধ্যে ২০১০ সালে আয় বৈষম্য ছিল ৩০ গুণ আর এখন তা হয়েছে ৭০ গুণ। ফলে মানুষের আয় বড়লেও দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য না কমে উল্টো বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের যে কাজের ধরন তা আয় বর্ধক নয়। অধিকাংশ মানুষ বেসরকারি খাতে কাজ করে। সেখানে উঁচু পর্যায়ে অনেক বেতন বাড়লেও নীচের দিকে তেমন বাড়ে না।

তার কথা, ‘সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তার নামে সহায়তা দেয়, সেটা আয় বর্ধক নয়। তারা টিকে থাকতে পারে মাত্র। আর এখানকার ট্যাক্স সিস্টেম প্রোগ্রেসিভ নয়। হওয়া উচিত ছিল আয় বেশি হলে আনুপাতিক হারে ট্যাক্স বেশি দেবে। কিন্তু তারা কর কম দেয়। কর ফাঁকি দেয়।


তার মতে, ‘নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে বংশ পরম্পরায় একই অবস্থায় না থাকে তার জন্যও কোনো ব্যবস্থা নেই। এই ধারা চলতে থাকলে আয় বৈষম্য আরো বাড়বে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা আয় বৈষম্যে এখনো চরম পর্যায়ে যাইনি। তবে এখনই এটা সামাল দেওয়া দরকার।

আর সিরডাপের পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক . মো. হেলালউদ্দিন বলেন, ‘আয়বৈষম্য মানে যে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়ছে না তা নয়। কিন্তু তাদের আয় বাড়ছে ধীরগতিতে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি হওয়ার ফল পাচ্ছে কিছুসংখ্যক মানুষ। আয়ের সিংহভাগ কিছু লোকের হাতে চলে যাচ্ছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি হওয়া রাষ্ট্রগুলোতে এমন পরিস্থিতি আগেও দেখা গেছে। আর আমাদের যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তাতে প্রবৃদ্ধি রিইনভেস্টমেন্টে বেশি যায়। ফলে শ্রমিকরা কম পায়

আবার মূদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার চাপ পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। যারা উচ্চ আয়ের, তাদের  আবার একই কারণে আয় বেড়ে যায়। বাংলাদেশ একটি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দেশ,’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ। 

তার কথা, ‘সরকারকে এটা ম্যানেজ করতে হয় নানা ধরনের ইনসেনটিভ দিয়ে। পৃথিবীর অনেক কল্যাণরাষ্ট্র আছে যেখানে উচ আয়ের লোজনকে তাদের আয়ের ৭০ ভাগ কর দিতে হয়। রাষ্ট্র ওই করের টাকায় নাগরিকদের জন্য নানা সুবিধা নিশ্চিত করে। ফলে যাদের আয় কম, তাদের সুবিধা বা ভোগ কম হয় না। আয় বৈষম্য প্রকট হয় না।’ -ডয়চে ভেলে

 

(এনডিটিভি/৩০ ডিসেম্বর/এসএন)