ডেস্ক রিপোর্ট: গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হয়েছেন। সোমবার রাতে যশোরের শার্শা সীমান্ত এলাকা থেকে বিজিবি সদস্যরা তাকে আটক করেন। বর্তমানে তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির আব্বাস জানান, বিনা পাসপোর্টে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিরণের বিরুদ্ধে গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন থানায় অনেক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও হত্যার অভিযোগও রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিরণের বাবা নূর মোহাম্মদ ছিলেন একটি স্কুলের দপ্তরি। কিরণ প্রথমে টঙ্গীর একটি কারখানায় কর্মচারী হিসেবে চাকচি করতেন। পরে তিনি টঙ্গী পৌরসভার কমিশনার হন। এরপরই তার ভাগ্য খুলে যায়। টাকা ও ক্ষমতার জোরে তিনি একাধিকবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হন। এরপর তিনি দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যান।
১৯৮৫ সালে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামে একটি কারখানায় বাইন্ডারম্যান পদে চাকরি করতেন আসাদুর রহমান কিরণ। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রথমে তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যোগ দেন। ওই সময় তিনি জাতীয় যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরশাদ সরকারের সময় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পরিচিতি পান ভূমিদস্যু হিসেবে। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসন পাকাপোক্ত করে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং দুই দফায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়রের পদ বাগিয়ে নেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, কিরণ ও তার স্ত্রীর নামে নিউইয়র্ক শহরে তিনটি বাড়ি, রাজধানীর উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় ৭ নম্বর সেক্টরে ১২তলা বাড়ি, রূপায়ণ সিটি উত্তরায় দুটি লাক্সারিয়াস কন্ডোনিয়াম ফ্ল্যাট, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় নিজের এবং স্ত্রীর নামে ২০০ বিঘা জমির ওপর ফ্যাক্টরি, রাজধানীর গুলশান-২-এ ফ্ল্যাট, টঙ্গীর পাগার এলাকায় তিনটি ফ্যাক্টরি, আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজের, স্ত্রীর ও শ্যালক-শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমি রয়েছে। এ ছাড়া টঙ্গীর পাগার মরকুন কবরস্থান জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে। আসাদুর রহমান কিরণ মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতা, চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্য, দরপত্র ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স কম দেখানোসহ বিভিন্ন খাত থেকে সিটি করপোরেশনের তহবিল আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এলাকাবাসী জানান, মূলত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানের ইশারায় চলতেন কিরণ। এ সুযোগে কিরণ সিটি করপোরেশনকে পরিণত করেছিলেন লুটপাটের কেন্দ্রে। আলাদিনের চেরাগের মতো সম্পদও গড়েছেন দেশ ও বিদেশে। তার অবৈধ অর্থের একটি ভাগ পেতেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও আজমত খান।
স্থানীয় লোকজন জানান, টঙ্গীর পাগার মৌজায় সনাতন ধর্মের লোকের দখলে থাকা বহু জমি দখলে নিয়ে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেন। একই সময় টঙ্গীর বিসিক এলাকায় শ্রমিকনেতা হিসেবেও আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। সে সময় কেউ জমি দিতে না চাইলে রাজনৈতিক চাপ ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করতেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল হওয়ায় ওই এলাকায় টার্গেট করে জমি দখল করেন কিরণ। তার ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
২০০০ সালে টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনের ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন আসাদুর রহমান কিরণ। তত দিনে ক্ষমতা-সম্পদ ও অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। ধীরে ধীরে সাবেক পৌর মেয়র গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহর ‘মাইম্যান’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। এ সুযোগে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে কিরণের। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমত উল্লাহ মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। পরে ষড়যন্ত্র করে মান্নানকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করিয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান আজমত উল্লাহর লোক কিরণ। ভাগ্যের চাকা আরও গতি পায় প্রথম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই। পরের মেয়াদে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ফের তাকেও বরখাস্ত করে কিরণকে বসানো হয় ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে। সঙ্গে দেওয়া হয় মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতি পদও। সাধারণ একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর হয়ে প্রতাপের সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশন শাসন করেছেন দুই মেয়াদে।
এনডিটিভি/এলএ