নিজস্ব প্রতিবেদক : অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ভ্যাট আদায়ের ডিজিটাল মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালুর চার বছর পরও অচলাবস্থা কাটছেই না। এনবিআর ও প্রকল্পের সহযোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের ব্যর্থতায় ভ্যাট ব্যবস্থার ডিজিটাল প্লাটফর্মটি থমকে আছে।
এনবিআরের অভিযোগ ক্রয় ও সেবা চুক্তি ভঙ্গ করেছে জেনেক্স। তবে পাল্টা এনবিআরের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগসহ অন্তর্র্বতী সরকারের অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জেনেক্স।
চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, বিল বুঝে না পাওয়া, মার্কিন ডলারের দর বৃদ্ধি ও ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতার কারণে ভ্যাট ব্যবস্থার ডিজিটাল প্লাটফর্মটিতে অচলাবস্থা চলছে।
জানা গেছে, এনবিআরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে প্রথম ধাপে হাজার ইএফডি যন্ত্র বসানোর কথা ছিল জেনেক্স-এর। তবে কোম্পানিটি দাবি করেছে- তারা প্রায় দুই বছরে ১৪ হাজার যন্ত্র স্থাপন করেছে। তবে এনবিআরের দাবি, ১১ হাজার ৩১৩টি ইএফডি স্থাপনের প্রমাণ পেয়েছে তারা।
এমন অবস্থায় জেনেক্স ক্রয় ও সেবা চুক্তিও ভঙ্গ করেছে বলে দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ইএফডি মেশিন সরবরাহের ক্ষেত্রে জেনেক্স শুরুতে শর্ত অনুযায়ী মানসম্মত মেশিন সরবরাহ করেছে। তবে পরবর্তীতে ক্রয় চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে নিম্নমানের মেশিন বাজারে সরবরাহ করে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, বিল বুঝে না পাওয়া, মার্কিন ডলারের দর বৃদ্ধি ও ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জেনেক্স।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা বলেন, বছরে ৬০ হাজার মেশিন সরবরাহের শর্ত থাকলেও জেনেক্স তা করতে পারেনি। কেন ক্রয় ও সেবা চুক্তি ভঙ্গ করেছে এর ব্যাখ্যা চেয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে শোকজ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতি মাসে ইএফডি লটারির বিষয়টি ভোক্তা পর্যায় থেকে যথেষ্ট সাড়া না পাওয়ায় গত আগস্ট থেকে ইএফডি লটারি বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন আমরা ভ্যাট আহরণ ইএফডি মেশিনের মাধ্যমে সক্রিয় রাখবো নাকি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজ করবো তা নিয়ে শিগগির সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা হবে। অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির সাহায্যে অটোমেশনের কাজ করবে এনবিআর।
জেনেক্স ইনফোসিস পিএলসির কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান আবু জাহিদ পরাগ দাবি করেন, এনবিআর থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও চিঠি পাননি তারা।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এনবিআর থেকে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। আমরা এ প্রকল্পের মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় রাজস্ব উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত বিকাশে সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত আছি। এনবিআর এই প্রকল্পের সফল অগ্রগতির জন্য কিছু পূর্বশর্ত বেধে দিয়েছে। যেগুলো আমরা বর্তমানে আরও কার্যকর ও সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করছি।
অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জেনেক্স
গত ১৩ আগস্ট এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, বিল বুঝে না পাওয়া, মার্কিন ডলারের দর বৃদ্ধি ও ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতাসহ নানা অভিযোগ তুলে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জেনেক্স।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী শাহ জালাল উদ্দিন সই করা চিঠিতে বলা হয়, এই উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগের আশানুরূপ সুফল মিলছে না। কিছু খুচরা ব্যবসায়ী- এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও আন্তরিকতার অভাবে এই প্রকল্প কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে।
এতে বলা হয়, প্রকল্প গ্রহণের সময় থেকে বর্তমানে মুদ্রার মানে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। দরপত্র জমা দেওয়ার সময় ডলারের দর ছিল ৮৫ দশমিক ৮৬ টাকা। বর্তমানে এই দর গিয়ে ঠেকেছে ১২০ টাকায়। বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যাংকগুলো থেকে এলসি খোলায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে ডিভাইস আমদানির লক্ষ্যমাত্রা জটিল করে তুলেছে।
চিঠিতে জেনেক্স জানায়, তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও এনবিআর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে ইএফডি ডিভাইস। এসব কাজে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। তবে এই বিলের টাকা এখনও বুঝে পায়নি তারা।
জেনেক্স জানায়, প্রকল্পের সঙ্গে চারটি টিম জড়িত এনবিআর ও জেনেক্স)। যেহেতু এটি দেশে অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি, সেহেতু এর সিস্টেমে কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট সকল টিমের মধ্যস্থতায় এর সমাধান করতে হয়। এতে অনেক সময় ও জটিলতা তৈরি হয়। সম্পূর্ণ সিস্টেমের দায়িত্ব এনবিআর-এর তত্ত্বাবধানে জেনেক্সে ওপর অর্পিত হলে তা অনেক বাস্তবসম্মত ও সহজ হবে।
এনবিআরের বিভিন্ন নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের চুক্তির আওতায় কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট এর ৫টি কমিশনারেট এর আওতাধীন এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইএফডি ও এসডিসি সরবরাহ, সংস্থাপন ও মনিটরিংয়ের কাজ করার কথা জেনেক্স ইনফোসিসের।
প্রাথমিকভাবে ৫টি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট (ঢাকা উত্তর/দক্ষিণ/পূর্ব/পশ্চিম, চট্টগ্রাম) ইএফডি ও এসডিসি স্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর।
ডিজিটাল মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সংগ্রহ করতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসানোর কাজে গতি ফেরাতে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জেনেক্স।
প্রায় ৫ বছর আলোচনা ও পাইলট প্রকল্পের পর ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে খুচরা ব্যবসায় ইএফডি যন্ত্র বসাতে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে এনবিআর। লক্ষ্য ছিল প্রায় ২৫ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে ভ্যাট আদায় করা। তবে এক বছরে ইএফডি যন্ত্র বসিয়ে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
সর্বশেষ তথ্যানুসারে, রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, বসুন্ধরা সিটি, মৌচাক, বেইলি রোডের কিছু দোকানে ইএফডি যন্ত্র থাকলেও, দোকানিরা তা ব্যবহার করেন না। জনপ্রিয় করতে ইএফডি কুপনের ওপর লটারির ব্যবস্থা করে এনবিআর, তবে সেই লটারিতেও আগ্রহ ছিল না ক্রেতাদের। গত ২২ আগস্ট ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে ইএফডি যন্ত্রের বিকল্প চিন্তা করার নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। এছাড়া ভ্যাট উইং এ কীভাবে আরও বেশি অটোমেশন করা যায় তার রূপরেখা বের করার তাগিদ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে ভ্যাট বিভাগের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ইএফডি লটারি বন্ধ হয়েছে৷ লটারিতে কোনো সাড়া মিলছে না। এ পর্যন্ত ১৩টি লটারি হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরস্কারের জন্য কোনও বিজয়ী পাওয়া যায়নি। কেউ চালান কপি সঙ্গে রাখেন না, দোকানিরাও এটা ব্যবহার করেন না। এই লটারির টাকাটা দোকানিকে দিলে বরং তারা উদ্বুদ্ধ হতো এবং ইএফডি ব্যবহার করতো।
এনডিটিভিবিডি/০৭সেপ্টেম্বর/এএ