যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজায় ধসে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। সাত মাসের বেশি সময় ধরে সেখানকার বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে ছোট্ট এই ভূখণ্ডটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল। গাজায় উচ্চ শিক্ষার জন্য যে ১২টি প্রতিষ্ঠান ছিল তার সবগুলোই ধ্বংস করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেও উদ্বাস্তু হয়ে গাজার ভেতর বা বাইরে অবস্থান করা সেখানকার শিক্ষার্থীরা মরিয়া হয়ে নিজেদের শিক্ষা গ্রহণ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যার অংশ হিসেবেগাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় নগরী খান ইউনিসের কাছে একটি তাঁবুর ভেতর বালির উপর বসেই শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে। আবার মিশরের রাজধানী কায়রোতে বসে গাজার উদ্বাস্তু দুই বোন অনলাইনে পশ্চিম তীরের একটি স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্লাস করছে।
অন্যদিকে, জার্মানিতে অবস্থান করা এক অধ্যাপক চেষ্টা করছেন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করে দিতে।
গাজা যুদ্ধে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে রাফা অভিযান নিয়ে। ইসরায়েলি বাহিনী যেকোনো সময় মিশর সীমান্তবর্তী গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় এই নগরীতে স্থল অভিযান শুরু করবে। এজন্য তারা রাফার বাসিন্দা এবং সেখানে আশ্রয় নেওয়া মোট প্রায় ১৪ লাখ ফিলিস্তিনিকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ছোট্ট শহর আল-মাওয়াসিতে চলে যেতে বলেছে।
আল-মাওয়াসির কাছে এপ্রিলের শেষ দিকে তাঁবুর ভেতর স্কুল শুরু করেন কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। তাদেরই একজন আসমা আল-আসতাল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিচ্ছি এবং আমাদের আরও অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা স্কুলে ভর্তির অপেক্ষা করছে।
“আমরা তাদের সাথে থাকবো, আমরা তাদের এখানে নিয়ে আসবো এবং আমরা তাদের পড়াবো।”
গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের কারণে গাজার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ, গাজার দুর্দশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য শিক্ষা ছিল তাদের আশা ও গর্বের বিরল এক উৎস। এখন তাদের ভয়, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রয়টার্স জানায়, গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে শিক্ষিতের হার অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বিচারে যা উচ্চ স্তরে পড়ে। কিন্তু ইসরায়েলের অবরোধ এবং বার বার সংঘাতের কারণে গাজায় শিক্ষা ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে এবং সম্পদের অভাবও মারাত্মক।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানকার স্কুলগুলোতে হয় বোমা ফেলা হয়েছে বা সেগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। গাজায় প্রায় ছয় লাখ ২৫ হাজার স্কুলগামী শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা এখন স্কুলে যেতে বা ক্লাস করতে পারছে না।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গাজায় উচ্চ শিক্ষার জন্য যে ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল সেগুলোর সবগুলোই যুদ্ধে হয় ধ্বংস হয়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলোতে প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষার্থী লেখপড়া করতো। যুদ্ধে ৩৫০ জনের বেশি শিক্ষক এবং অধ্যাপক নিহত হয়েছেন।
গাজা সিটির আল আজহার ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের মেডিকেল শিক্ষার্থী ইসরা আজুম বলেন, “আমরা বন্ধুদের হারিয়েছি, চিকিৎসকদের হারিয়েছি, শিক্ষা সহকারীদের হারিয়েছি, অধ্যাপকদের হারিয়েছি, এই যুদ্ধে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি।”
আজুম দেইর আল-বালাহ শহরের আল আকসা হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে তিনি মূলত রোগীর ঢল সামলাতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাওয়া চিকিৎসাকর্মীদের সহায়তা করতে কাজ করছেন। তবে একইসঙ্গে তিনি চান না ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাক’। তাই তিনি হাসপাতালে কাজ করছেন।
বলেন, “আমি কখনও ক্লান্ত বোধ করি না। কারণ, আমি এই কাজটাই করতে চাই। আমি ওষুধ ভালোবাসি, আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে ভালোবাসি এবং আমি যা শিখেছি তা ভুলে যেতে চাই না।”
আল আকসা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান এবং মেডিসিন ফ্যাকাল্টির লেকচারার ফাহিদ আল-হাদাদ আশা করছেন, আবার তিনি শিক্ষাদান শুরু করতে পারবেন। যদিও তার বইপত্র, দশ বছরের বেশি সময় ধরে তৈরি করা তা তার নোটপত্র সব গাজা সিটিতে তার বাড়িতে হামলার কারণে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “এখানে দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থার কারণে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করাও বেশ কঠিন। তারপরও ইন্টারনেটের কল্যানে শিক্ষার্থীরা অনন্ত তাদের লেখাপড়া শেষ করে ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ পাচ্ছে। আইইউজি এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং সেগুলো এখন পরিত্যক্ত।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হাদিদ আরও বলেন, “আমরা যে কোনো উপায়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালিয়ে যেতে প্রস্তুত আছি। যদিও এটা গাজার বাইরের চেয়ে গাজার ভেতরে হলে ভালো হয়। কারণ, ভুলে যাবেন না আমরা চিকিৎসক এবং আমরা এখানে কাজ করছি।”
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেখানকার কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি সীমান্ত পেরিয়ে মিশরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদেরও শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। যদিও তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে রয়েছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে তারা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। তাই কেউ কেউ অধিকৃত পশ্চিম তীরের স্কুলগুলো থেকে দেওয়া দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে শিশুদের যুক্ত করার চেষ্টা করছেন।
মিশরে ফিলিস্তিন দূতাবাস থেকে গাজার ৮০০ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
পাঁচ মাস আগে পরিবার নিয়ে গাজা থেকে মিশরের রাজধানী কায়রোতে আশ্রয় নেন ৪৬ বছর বয়সী ব্যবসায়ী কামাল আল-বাতরাউই। তিনি জানান, সেখানে তার দুই মেয়ে অনলাইনে স্কুল করা শুরু করেছে।
বলেন, “তারা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ক্লাস করে। মনে হয় যেনো তারা নিয়মিত স্কুলে রয়েছে। এটা জীবন রক্ষাকারী উদ্যোগ।”
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ১০ লাখের বেশি উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সেখানে গান ও নাচের মত বিনোদনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের কিছু প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইউনিসেফ সেখানে অর্ধশত তাঁবু ভিত্তিক স্কুল চালু করার পরিকল্পনা করেছে। যেখানে প্রতিদিন তিন শিফ্টে প্রায় ছয় হাজার শিশুকে পাঠদান করা হবে।
ইউনিসেফ ফিলিস্তিন এর হেড অব কমিউনিকেশন জনাথন ক্রিক্স বলেন, “এটা করা খুবই জরুরি। যদিও এটা প্রয়োজনের সমুদ্রে এক ফোঁটা পানির মত।”
গাজা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্যাকাল্টির ডিন ওয়াসেম আমির বলেন, “যদিও অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম একটি অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান। কিন্তু চিকিৎসা ও প্রকৌশলের মত বিষয়গুলোতে ক্লাসে সশরীরে উপস্থিতি থাকা এবং হাতেকলমে শিক্ষার প্রয়োজন হয়। যা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে সম্ভব হয় না।”
গত বছর নভেম্বরে গাজা থেকে জার্মানিতে চলে যান এই অধ্যাপক। তিনি এখন শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিচ্ছেন যে কিভাবে তারা পশ্চিম তীর বা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কোর্সের বাকিটা শেষ করার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, “যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ভবন বা অবকাঠামো ঠিক করাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ হবে না। বরং যুদ্ধে যে কত শত শিক্ষক নিহত হয়েছেন তাদের স্থান পূরণ করা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।”
গাজা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ গাজা (আইইউজি) এর প্রেসিডেন্ট সুফিয়ান তায়েহও রয়েছেন। গত ডিসেম্বরে তার বোনের বাসায় আশ্রয় নিয়ে থাকার সময় স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানসহ নিহত হন এই অধ্যাপক।
তার ভাই নাবিল রয়টার্সকে বলেন, “তায়েহ থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স এবং অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স এ একজন পুরস্কার পাওয়া অধ্যাপক ছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি একজন অনুরক্ত মানুষ ছিলেন তিনি।
“এমনকি যুদ্ধের মধ্যেই তিনি তার গবেষণা নিয়ে কাজ করছিলেন।”
জাতিসংঘের হিসাব মতে, গাজার প্রায় ৭৩ শতাংশ স্কুলের সম্পূর্ণ পুনঃনির্মাণ অথবা বড় আকারে সংস্কারের প্রয়োজন হবে।
বোমায় ধ্বংস হওয় যাওয়া স্কুলগুলোতে পুনরায় যাওয়ার মত মনোবল পেতে এবং নিরাপদ অনুভব করতে গাজার শিশুদের মানসিক ও শারীরিক সহায়তার প্রয়োজন হবে বলেও মনে করেন ইউনিসেফ কর্মকর্তা ক্রিক্স।
এনডিটিভি/পিআর