ঢাকা , মঙ্গলবার, জুলাই ১৫, ২০২৫

বাস্তবতাবিবর্জিত রাজউকের পরিকল্পনা : নানা জটিলতায় গতিহীন ঝিলমিল প্রকল্প

Jul ১৪, ২০২৫
জাতীয়
বাস্তবতাবিবর্জিত রাজউকের পরিকল্পনা : নানা জটিলতায় গতিহীন ঝিলমিল প্রকল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নয়ন’ ছিল রাজউকের একটি বাস্তবতাবিবর্জিত পরিকল্পনা। ক্রয় কার্যক্রমে স্থবিরতাসহ নানা জটিলতায় গতিহীন হয়ে পড়েছে এই প্রকল্পটি। দুদফা মেয়াদ (৪ বছর) বাড়িয়ে ৮ বছরে এর ভৌত অগ্রগতি ৫২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি আরও কম। এর মধ্যে ৩৪টি ক্রয় প্যাকেজের মধ্যে মাত্র ২০টির ৫৮ দশমিক ৮২ শতাংশ কাজ হয়েছে। প্রকল্পটিতে চার ধরনের দুর্বল দিক এবং চারটি চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। সেখানে বলা হয়, ঢাকা শহরকে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণ করে পরিকল্পিত আবাসন ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা সৃষ্টিই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করার কথা থাকলেও সহজেই সুবিধা মিলছে না। একদিকে নিরাপত্তার অভাব, ইউটিলিটি সেবার অভাব এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের ধীরগতির কারণে প্লট মালিকরা ভবন নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছেন না। আরও বেশি দেরি হলে তাদের মধ্যে সৃষ্ট চাপা ক্ষেভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সরকারের এই বিভাগটি।

এ প্রসঙ্গে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, যেনতেনভাবে প্রকল্প নেওয়ার খেসারত হিসাবে টাইম ওভার রান (অতিরিক্ত সময়) হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতেই যদি সমস্যা থাকে তাহলে অবশ্যই বাস্তবায়ন পর্যায়ে জটিলতা দেখা দেবে। আইএমইডির প্রতিবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই।

আইএমইডি জানান, প্রাথমিক পর্যায় ‘ঢাকা-মাওয়া রোডের পার্শ্বে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের লোকদের জন্য আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (ঝিলমিল)’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ১৯৯৮ সালে। ১৩৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর নতুন করে ‘ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটি হাতে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ৮৯৮ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয় ধরে এটি অনুমোদন দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় কমিয়ে ধরা হয় ৪২৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় আরও কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ৪০৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এদিকে অনুমোদনের সময় প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে দুদফায় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করা হয়েছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

আইএমইডি বলছে, শুরু থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক ৪১ শতাংশ এবং বাস্তব ৫২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। কাজভিত্তিক বাস্তবায়নের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাস্তা নির্মাণের অগ্রগতি ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। তবে হাসপাতাল নির্মাণ না হওয়ায় এ রাস্তার কিছু অংশের কাজ এখনো বাকি। সারফেস ও ক্রস ড্রেন উভয়ের কাজ হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। এছাড়া পার্ক উন্নয়ন কাজ রাজউকের সবুজায়নের কারণে এখনো শুরুই হয়নি। ওয়াকওয়ে, স্লোপ প্রটেকশন ও খেলার মাঠের কাজ রাজউকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এগুলো আর বাস্তবায়ন করা হবে না। বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ আংশিকভাবে ৬৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ হয়েছে, তবে সংযোগ এখনো বাকি। মসজিদের কাজ ২০ শতাংশ, স্কুল ও কলেজ ১৫ শতাংশ এবং কবরস্থানের কাজ হয়েছে ৮ শতাংশ। তবে সীমানা পিলার, সাইট অফিস ও বৃক্ষরোপণ কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটিতে ধীরগতি বিরাজ করছে। এর অন্যতম কারণ হলো, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়া, পদ্মা সেতু লিংক রোড নির্মাণ, করোনা মহামারি, প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ড্রইং সংশোধন, ক্রয় পরিকল্পনার পরিবর্তন ইত্যাদি। প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে ইতোমধ্যেই দুটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ, একটি ছয়তলা পাসপোর্ট অফিস তৈরি, ২২ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি, গভীর নলকূপ স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে।

আইএমইডির চিহ্নিত উল্লিখিত প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলো হলো-নির্মাণ কাজে দেরি হওয়ার কারণে অর্থ বরাদ্দ এবং প্রকল্পের অগ্রগতি ধীর। এছাড়া ক্রয় ও দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়ায় প্রশাসিনক জটিলতা ও সময়ক্ষেপণ হয়েছে। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবসম্মমত না হওয়ায় কাজের সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। প্রকল্পের নকশা তৈরি ও পরিকল্পনায় কার্যকর এবং বাস্তবভিত্তিক দিকনির্দেশার অভাব আছে। প্রকল্পের আওতায় যেসব ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো হচ্ছে-প্রশাসনিক জটিলতা প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া লেক ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলে পরিবেশগত ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট প্রকল্পের বাজেট এবং কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাগরিক সুবিধাগুলো সময়মতো নিশ্চিত করা না গেলে উপকারভোগীদের অসন্তোষ বাড়তে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটি গত মাসে শেষ হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন এখনো অসম্পন্ন রয়েছে বা কাজই শুরু হয়নি। প্রকল্পের শুরুতেই বাস্তবভিত্তিক ও পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ ছাড়াই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। ফলে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপে দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়ায় রাজউকের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও কার্যকর মূল্যায়নের অভাবে উদ্ভূত সমস্যাগুলো সময়মতো চিহ্নিত ও সমাধান করা যায়নি। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী পিইসি (প্রকল্প ইভাল্যুয়েশন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি) সভা নিয়মিত হয়নি। এটি প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সন্তোষজনক নয়। অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। প্রকল্পটি মানসম্মতভাবে বাস্তবায়নে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে অনুমোদিত অর্গানোগ্রাম অনুসরণ করা জরুরি বলে মনে করছে আইএমইডি।

এনডিটিভিবিডি/১৪ জুলাই/এএ