নিজস্ব প্রতিবেদক : নির্বাচনে অনিয়ম বন্ধে এবার কর্মকর্তা নিয়োগে কৌশলে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে। কোথাও কোথাও জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োগ দেওয়ার আভাস দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট দিতে আগে থেকেই নিবন্ধনের কথাও বলেন তিনি। শুধু নিবন্ধিত প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাররাই পোস্টাল ব্যালটে প্রথমবারের মতো অংশ নিতে পারবেন ভোটে।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিইসি সাফ জানিয়েছেন, সংসদীয় আসনে সীমানা নির্ধারণে অসংখ্য আবেদন জমা পড়লেও এবার কারও দ্বারা প্রভাবিত হবে না ইসি।
সম্প্রতি অর্ন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ১৮-৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য ভোটকেন্দ্রগুলোতে আলাদা বুথের বিষয়ে ইসিকে ভাবতে বলা হলেও সিইসি জানিয়েছেন এ বিষয়ে তারা এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেননি।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে পারা না পারার প্রশ্ন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন সিইসি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটের সুযোগ দিতে এবার প্রথমবারের মতো উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য চার ধরনের ভোটিং পদ্ধতির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে।
শুরুতে প্রক্সি ভোটিং, অনলাইন, পোস্টাল কিংবা সশরীরে ভোট-এই চারটি বিকল্প পদ্ধতিকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেছিল নির্বাচন কমিশন। তবে শেষ পর্যন্ত পোস্টাল ব্যালটেই ভোটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোট নিয়ে আমরা নানা ধরনের অপশন নিয়ে আলোচনা করেছি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত দেখলাম ম্যাক্সিমাম লোকই পোস্টাল ব্যালটটাকে সাপোর্ট করে। এজন্য আমরা কমিশন থেকে ডিসিশন নিয়েছি যে ভোট হবে অনলাইন বেসড পোস্টাল ব্যালট’।
যে সব প্রবাসী আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন তাদের আগে থেকেই অনলাইন রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে বলেও জানান সিইসি।
সিইসি বলেন, ‘আমরা এখন অনলাইনে একটা প্ল্যাটফর্ম বানাবো, মানুষের অপশন নেওয়ার জন্য, তাদেরকে প্রবাসী ভোটার হিসেবে ট্রিট করবো। পরে তাদের কাছে ব্যালট পেপার পাঠাবো। এটা অনেকটা কস্টলি (ব্যয়বহুল) হবে। আমরা এজন্য ডিএইচএল ও ফেডেক্সের (আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস) সঙ্গে কথা বলেছি। একেকটা ভোটের জন্য পাঁচ হাজার টাকা লাগবে’।
নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এটা হলো ডিএইচএল ও ফেডেক্সের খরচ। তবে সরকারি পোস্ট অফিসের মাধ্যমে এটা করলে ভোটার প্রতি ৭০০ টাকা খরচ হবে। আমরা অভিয়াসলি সরকারি পোস্ট অফিসকে ইউজ করবো। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা স্পেশাল অ্যারেজমেন্ট করবে। কুইকলি যাতে হয়’।
তিনি বলেন, ‘এখানে আরেকটা বিষয় আপনাদেরকে জানা দরকার, আমরা যে শিডিউল দেই, নমিনেশন পেপার থেকে শুরু করে সবকিছু, প্রতীক বরাদ্দ না হলে তো আমরা দিতে পারি না। যখন প্রতীকটা বরাদ্দ তখনই না আমরা ব্যালট পেপার ছাপাই। সুতরাং এই যে ব্যালট পেপার ছাপানো থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত আমরা কমবেশি ১২ দিন মাত্র সময় পাই। কারণ এই পোস্টাল ব্যালট যখন আমরা এক্সিকিউট করবো, আমাকে এই ১২ দিনের মধ্যেই ব্যালট পাঠানো, ব্যালট ফেরত আনা করতে হবে’।
বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল, তাহলে কী মাত্র ১২ দিনের মধ্যে প্রবাসীরা ভোট দেওয়ার পর ব্যালট দেশে ফেরত আনা সম্ভব?
জবাবে সিইসি বলেন, ‘এটা সম্ভব, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায় ২৪ শতাংশের মতো সিস্টেম লস আছে। আমাদের মতো দেশে এটা আরও অনেক বেশি সিস্টেম লস হতে পারে। অনেক ব্যালট পেপার একজনের কাছে পাঠালাম, দেখা গেলো ভোট দিলো না। এতে অনেক ব্যালট নষ্ট হতে পারে। তখন এগুলো বাতিল ভোট হয়ে যাবে। সুতরাং এই ঝুঁকিগুলো আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি যে, মোটামুটিভাবে একটা সাইজাবেল নম্বর, প্রবাসীদেরকে আমরা নিয়ে আসবো’।
তবে নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এবার নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘দিস আওয়ার কমিটমেন্ট, উই আর সিরিয়াসলি ওয়ার্কিং অন ইট। গোঁড়া থেকেই আমরা এটারও পর এক্সারসাইজ করছি। সুতারং ইনশাল্লাহ আমরা এটা ইমপ্লিমেন্ট করবোই করবো’।
বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রের মূল দায়িত্বে থাকেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। তাদেরকে সহযোগিতা করে থাকেন সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা।
সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনগুলোতে দেশে ৪০ হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুল কলেজের শিক্ষকদেরই প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হতো। সংসদসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সহায়তায় নির্বাচনে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে প্রশ্ন ছিল পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবার প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগে নিয়মের কোন পরিবর্তন আনছে কি না ইসি?
জবাবে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘একচুয়ালি আমরা কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তা করছি। কারণ বিগত নির্বাচনগুলোতে, যারা রিগিংয়ে (ভোট কারচুপি) সহায়তা করেছে যে সব প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, আমরা তাদেরকে যথাসম্ভব পরিহার করবো’।
সেটি কীভাবে যাচাই বাছাই করা হবে তারও ব্যাখ্যায় সিইসি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন কমিশনের জেলা অফিসাররা সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আমরা অলরেডি এই কাজ শুরু করেছি। যথাসম্ভব আগামী নির্বাচনে তাদেরকে আমরা পরিহার করবো। তাদেরকে কাজে লাগাবো না’।
তাহলে কাদেরকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হবে? সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের চিন্তা আছে ব্যাংকের অফিসারদের দায়িত্ব দেওয়া। কারণ এরা তো সরকারে ছিল না। এরা তো রিগিংয়ের সহযোগী ছিল না। আমরা ব্যাংকগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখছি’।
রিটার্নিং কর্মকর্তা কারা হবেন?
সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সারাদেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা।
শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন। যে কারণে বিভিন্ন সময় ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার কথাও উঠেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দিলেও জাতীয় নির্বাচনে সেটি দেওয়া হয়নি। যে কারণে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে সেখানে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে কী জেলা প্রশাসকরাই থাকছে নাকি নতুন কেউ আসছে?
এই প্রশ্নে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘সংস্কার কমিশনও এই প্রস্তাব করেছে। নির্বাচন কমিশনের অফিসাররা আগে তো এমন দায়িত্ব কখনও পালন করেননি। লোকাল গভর্নমেন্টে কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিল। বহু সিটি করপোরেশনে তো তারা রিটার্নিং অফিসার ছিল।
তাহলে আগামী নির্বাচনে কি ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পাচ্ছেন রিটার্নিং কর্মকর্তার?
এই প্রশ্নে সিইসি জানিয়েছেন, শুধু নিজস্ব কর্মকর্তা হলেই তাদেরকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেবে না ইসি। এক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘মোটামুটিভাবে তাদের যোগ্যতা দেখে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অফিসারদের নিয়োগ করবো। তবে শর্ত হলো যে, তাদেরকে উপযুক্ত কর্মকর্তা হতে হবে। বাকিটা আমাদের জেলা প্রশাসকের ওপর নির্ভর করতে হবে’।
তিনি জানান, ‘যাচাই করে যাদের যোগ্য মনে হবে তাদেরকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে’।
নির্বাচনের প্রশাসনিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে দায়িত্ব পালন করা হলে কী কোন সমস্যা তৈরি হবে কি না?
এই প্রশ্নে বিবিসি বাংলাকে সিইসি বলেন, ‘আশা করি সমস্যা হবে না। কারণ সরকার তো ম্যাসেজ দিচ্ছে সবাইকে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা আছে। সব কিছু মিলিয়ে আমি মনে করি না যে অসহযোগিতা পাওয়া যাবে। আমি নিশ্চিত যে সবার সহযোগিতা আমি পাবো। সে বিশ্বাস আমার আছে’।
সীমানা নির্ধারণে রাজনৈতিক চাপ আছে?
এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত কয়েক মাসে সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে অসংখ্য আবেদন জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এসব আবেদনে বেশির ভাগই ২০০৮ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। আবেদনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সীমানা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অনেক রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ইসিতে তদবিরও চালাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে আপনাদের ওপর কোন রাজনৈতিক চাপ আছে কি না জানতে চাওয়া সিইসির কাছে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ওপর কোন চাপ নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে অনেক আবেদন আছে। এটা চাপ না’।
সিইসি জানান, এ পর্যন্ত ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৭১টি সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে বিভিন্ন রকম আবেদন জমা পড়েছে ইসিতে। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে একজন নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।
এবার সংসদীয় আসনের সীমানা কীভাবে পুনঃনির্ধারণ করা হবে তার একটি ধারণা দিয়ে সিইসি বলেন, ‘সরকারি মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আমরা এটা নিয়ে কাজ করাচ্ছি। ১৪ জন স্পেশালিস্ট (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সার্ভিসেস-সিইজিআইএস) আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। সব কাজ প্রায় আমরা গুছিয়ে এনেছি। শিগগির আমরা খসড়া প্রকাশ করতে পারবো’।
এনডিটিভিবিডি/১৪ জুলাই/এএ