ডেস্ক রিপোর্ট: ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিভিন্ন পদে ৩০ জনকে নিয়োগের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরে সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগে নিজ জেলার যোগ্য প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হলেও এখানে ঘটেছে উল্টো। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সংসদীয় আসন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪-এর কসবা ও আখাউড়া উপজেলা থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০ জন। এখানেই শেষ নয়, আইনমন্ত্রীর পাঠানো তালিকার প্রার্থীদের তৎকালীন জেলা জজের খাস কামরায় বসিয়ে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। খাস কামরায় বসে পরীক্ষা দেওয়ার অন্তত ৩টি ছবি রয়েছে কালবেলার হাতে। এই ছবিতে যারা আছেন, তারা সবাই চাকরি পেয়েছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে। অভিযোগ এসেছে, নিয়োগ পাওয়া ৩৪ জনই আলাদা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নাজির পদে ৩ জন, হিসাবরক্ষক পদে ৪ জন, বেঞ্চ সহকারী পদে ৩ জন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে ৭ জন, ক্যাশিয়ার পদে ১ জন, লাইব্রেরি সহকারী পদে ১ জন, অফিস সহায়ক পদে ১০ জন ও নৈশ প্রহরী পদে ১ জনকে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর সরকারি বিধি অনুযায়ী প্রার্থীরা আবেদন করেন। ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল লিখিত পরীক্ষা হয়। ফল প্রকাশিত হয় একই বছরের ১৮ জুন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে ২৪ ও ২৫ জুন ভাইভা হয়। একই বছরের ২৩ আগস্ট চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। তবে ৩০ জনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও নিয়োগ দেওয়া হয় ৩৪ জনকে। এরপর চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর তাদের স্থায়ী করা হয়। এই ধরনের নিয়োগে নিজ জেলার প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা। নিজ জেলার যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে অন্য জেলা থেকে নেওয়া যাবে। তবে এখানে ঘটেছে উল্টো। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনী আসন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪-এর কসবা ও আখাউড়া উপজেলা থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ২০ জনকে। ২০ জনের তালিকা হাতে রয়েছে। গতকাল নিয়োগ বাতিল চেয়ে চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি লিখিত আবেদন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে চাকরি প্রার্থীদের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। পরীক্ষার হলের বাইরে বিশেষ কক্ষে পরীক্ষা নেওয়ার যে তিনটি ছবি হাতে এসেছে তার একটিতে দেখা যাচ্ছে, এক প্রার্থীর পরীক্ষার খাতার নিচে আরও একটি খাতা রয়েছে। সেই খাতায় দেখা যাচ্ছে, ৭০ মার্কের পরীক্ষায় ৫৫ মার্ক পেয়েছেন প্রার্থী। এই প্রার্থীর নাম রবিউল হাসান। চূড়ান্ত তালিকায় ১৬ নম্বরে নাজির হিসেবে চাকরি পেয়েছেন তিনি। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একই কায়দায় আলাদা কক্ষে বসে পরীক্ষা দিচ্ছেন সাব্বির হোসেন নামে এক প্রার্থী। তিনি চূড়ান্ত তালিকায় ৭ নম্বরে বেঞ্চ সহকারী পদে চাকরি পেয়েছেন। আরেকটি ছবিতে ৯ নম্বর ক্রমিকে বেঞ্চ সহকারী পদে চাকরি পাওয়া মামুনকে পরীক্ষা দিতে দেখা যায়। এই কক্ষটি তৎকালীন জেলা জজের খাস কামরা বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রত্যেকের খাতার নিচেই একই পরীক্ষার আরও একটি করে খাতা দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মানুযায়ী আবেদনকারীদের পরীক্ষা নেওয়া হলেও নিয়োগ দেওয়া হয় আইনমন্ত্রীর পাঠানো তালিকা থেকে। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সমন্বয় করেন তৎকালীন সিরাজগঞ্জ জেলা জজ ফজলে খোদা মো. নাজির। আইনমন্ত্রীর পাঠানো তালিকার প্রার্থীদের পরীক্ষার পরে ডেকে ডেকে খাতা ঠিক করা হয়। এ সময় তাদের কাছে ভালো নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেওয়া হয়। মন্ত্রীর পছন্দের পরীক্ষার্থীরা সেই খাতা দেখে দেখে উত্তরপত্রে ফের উত্তর লেখেন। ভুল করা উত্তর সংশোধন করে লেখেন। এই ঘটনা জানাজানি হলে তাৎক্ষণিকভাবে লোক দেখানোর ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর গোপন কক্ষের ছবি ফাঁস হওয়া তিনজনের নিয়োগ স্থায়ীকরণ আদেশ স্থগিত করা হয়। তবে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বাকি পরীক্ষার্থীদের বিষয়ে।
জাফর ইমাম নামে এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফেল করা প্রার্থীদের পরে ডেকে ডেকে জজের খাস কামরায় নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। আমরা এই নিয়োগ বাতিল চাই। অনেকে লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েও চাকরি পাননি। আবার অনেকে কোনো রকম পাস করেই নিয়োগ পেয়েছেন।
নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কয়েকটি পদের পরীক্ষার্থীদের ভাইভা ও লিখিত পরীক্ষার নম্বরের তালিকা এসেছে হাতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মো. খায়রুল ইসলাম মানিক নামে এক প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় ৭০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৪৬ নম্বর পেয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পেয়েছেন। ৪৫ নম্বর পেয়ে চাকরি পেয়েছেন মো. নুরনবী হোসেন। অন্যদিকে ৬২ করে নম্বর পেয়েও বাদ পড়েছেন মাছুমা খাতুন, মো. হোসেন আলী, তন্ময় সরকার, মো. গোলাম রাব্বানী। ৬৫ নম্বর পেয়েও বাদ পড়েছেন মো. রিজন আহমেদ, এসএম আব্দুল বাতেন। ৬৪ নম্বর পেয়ে বাদ পড়েছেন মো. শাহিন রেজা, মো. কাউছার আলীসহ আরও কয়েকজন। এ ছাড়া ৬০-এর ঘরে নম্বর পেয়ে বাদ পড়েছেন আরও কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন সিরাজগঞ্জ জেলা জজ বর্তমানে রংপুর জেলা জজ ফজলে খোদা মো. নাজির বলেন, ‘আমাদের মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে হলে সুপ্রিম কোর্টের পারমিশন লাগে। পারমিশন ছাড়া আমরা কথা বলতে পারি না।’ এরপর অভিযোগটা সুনির্দিষ্টভাবে আপনার বিরুদ্ধে। আইনমন্ত্রীর পাঠানো তালিকার প্রার্থীদের আপনি আপনার কক্ষে বসিয়ে আলাদা করে পরীক্ষা নিয়েছেন—এই অভিযোগের বিপক্ষে কিছু না বলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
এনডিটিভি/এলএ