ডেস্ক রিপোর্ট: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকের মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর পুরোটাই ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে দেশের বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলমকে। এছাড়া নামে-বেনামে আরও ২০ হাজার টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এসব টাকা কল মানি তথা অন্য ব্যাংক থেকে এনে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, নিয়মানুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো মোট আমানতের ৯২ শতাংশ ঋণ দিতে পারে। বাকি ৮ শতাংশ কেন্দ্রিয় ব্যাংকে (ঋণ আমানত অনুপাত-এডিআর) জমা রাখতে হয়। এ হিসেবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ৯২ শতাংশ ঋণ দিতে পারে ব্যাংক। এখন ৪৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেই, এর বাইরে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়ে বিনিয়োগ তথা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এখন এসব ঋণ যথাযথভাবে আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে গ্রাহকের আমানত চাহিদা মোতাবেক দিতে পারছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি ব্যাংকের মোট আমানতের পুরোটাই ঋণ হিসেবে এসআলম গ্রুপকে দেওয়ার সময় কোনো নিয়মনীতিরই তোয়াক্কা করা হয়নি। ঋণগুলো বিতরণের সময় মুখ খোলেননি কোনো কর্মকর্তা। এখন শিল্পগ্রুপটি দেওলিয়া হওয়ার পথে। গ্রুপটির শীর্ষ কর্মকর্তারা পলাতক। একে একে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণখেলাপি ঘোষিত হতে শুরু করেছে শিল্পগ্রুপটি। গত ১ ডিসেম্বর শিল্পগ্রুপটির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে জনতা ব্যাংক।
প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকটি আগ্রাবাদ চৌমুহনী জীবন বীমা শাখা মামলাটি দায়ের করে। আদালত ওইদিনই মামলাটি আমলে নিয়ে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে। এমতাবস্থায় মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা এস আলম গ্রুপের টাকা আদায়ে সাইফুল আলম মাসুদের চট্টগ্রাম নগরের সুগন্ধা ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।
ওই এলাকার বাসিন্দা জাবেদ চৌধুরী বলেন, “একসময় এই ভবনের সামনে এস আলম নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি নিয়োগ পেতে চাকরি প্রার্থীদের ভিড় লেগেই থাকত। চাকরি প্রার্থীরা রাতদিন সেখানে অবস্থান করতেন। ফজরের নামাজের সময়ও চাকরি প্রার্থীদের দেখা যেত। যারা মাসুদ সাহেবের সাক্ষাৎ পেতে অপেক্ষমাণ থাকতেন। কথিত ছিল, যাদেরকে ফজরের নামাজের সময় দেখতেন মাসুদ সাহেব তাদেরকেই ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতেন। একটি ব্যাংকের পুরো টাকা একটি শিল্পগ্রুপকে অনৈতিক পন্থায় দিয়ে এখন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সেই টাকা আদায়ে কর্মসূচি পালন করা রীতিমতো হাস্যকর।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবস্থান কর্মসূচীতে ব্যাংকটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোস্তফা, আগ্রাবাদ শাখার মোশারফ হোসেন, জুবলি রোড শাখার মোহাম্মদ আনোয়ার উল আলমসহ চট্টগ্রামের দুটি জোন ও নগরের ২১ টি শাখার ব্যবস্থাপকসহ শতাধিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, যারা ৫ আগস্টের আগ পর্য়ন্ত এস আলমের সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এস আলম গ্রুপকে এসব ঋণ দিতে তারা এতদিন কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেনি। সাবেক ব্যবস্থাপকদের মধ্যে খাতুনগঞ্জ শাখার মো. হেলাল উদ্দিন, আগ্রাবাদ শাখার মো. নোমান, জুবলি রোড শাখার আমির হোসেন, পাঁচলাইশ শাখার মাহবুব আলম, চকবাজার শাখার আবু হেনা মোস্তফা কামাল, রাহাত্তারপুল শাখার হারুনুর রশিদসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ঋণ বিতরণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে এদের ইতোমধ্যে শাখা থেকে প্রত্যাহার করে প্রধান কার্য়ালয় ও আঞ্চলিক কার্য়ালয়ে বদলি করেছে ব্যাংকটি।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গ্রাহকের আমানত নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। যেই ব্যাংকটিতে শুরু থেকে বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণ ছিল। সরকার পরিবর্তনের পরপরই গ্রাহক ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যদিও ৬ আগস্ট থেকে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। গ্রাহকের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে ধার দিলেও এখনো গ্রাহকের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি।
মুশফিকুর রহমান নামের এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, “ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক রাহাত্তারপুল শাখায় আমাদের একটি সমিতির প্রায় ৫০ লাখ টাকা জমা ছিল। গত পাঁচ মাস ধরে সেই টাকা ফেরত দিচ্ছে না ব্যাংকটি। সমিতির প্রতিনিধি প্রতিদিন শাখায় গিয়ে টাকা না পেয়ে বরং হয়রানির শিকার হচ্ছেন।”
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, “জনগণের আমানত গ্রহণ করে আমরা বিনিয়োগ করে থাকি। বিনিয়োগের টাকা আদায় না হওয়ায় এখন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। টাকা আদায়ের জন্য এ কর্মসুচি পালন করা হয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ করা ৬৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নামে-বেনামে ৪৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে এস আলম। এরমধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখা থেকে নিয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। যেই ঋণগুলোর মান এখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
একটি গ্রুপকে কেন এত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে আগের পরিস্থিতি এক ছিল না। যার কারণে বিনিয়োগগুলো সঠিক যাচাই বাছাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এনডিটিভি/এলএ