নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যস্থতায় প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোলাকুলি করে ‘আর সংঘাতে না জড়ানোর’ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরদিনই ফের সহিংসতা হয়েছে রাজশাহীর বাগমারায়।
মঙ্গলবার সকাল ও সন্ধ্যায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচি প্রতীকের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় তিনজনকে পিটিয়ে জখম করেছে নৌকার প্রার্থীর সমর্থকরা। উপজেলার পাহাড়পুর ও বালানগর গ্রামে দুই ঘটনায় আহত তিনজনকে বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কাঁচি প্রতীকের তিনটি নির্বাচনী ক্যাম্প। রাজশাহী-৪ আসনে এবার আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী রাজশাহীর তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আবুল কালাম আজাদ। আর গত তিনবারের এমপি এনামুল হক দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন কাঁচি প্রতীক নিয়ে। ভোটের প্রচারের শুরু থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে চলছে উত্তেজনা।
দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘাতের পর জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ডিসি শামীম আহমেদ এবং পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম সোমবার বিকালে বাগমারায় গিয়ে দুই প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে দুই প্রার্থী হাতে হাত রেখে সহিংসতা করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। দুজনের কোলাকুলির ছবিও সেদিন সংবাদমাধ্যমে আসে। কিন্তু তার পরদিনই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর নৌকার প্রার্থীর কর্মীদের হামলার ঘটনা ঘটল।
আহতরা হলেন, উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার পাহাড়পুর গ্রামের রজনী কান্ত (৩৮) ও অজিত কুমার (৪০) এবং বালানগর গ্রামের লুৎফর রহমান (৫৬)। তাদের মধ্যে রজনী কান্তের মাথা কেটে গেছে, আর অজিত কুমারের বাঁ হাত ভেঙে গেছে।সোমবার রাতে সমঝোতা বৈঠকে রাজশাহী-৪ আসনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আবুল কালাম আজাদ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৌশলী এনামুল হকের কোলাকুলি।
মঙ্গলবার রাতে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখতে যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক। এ সময় তিনি আহতদের চিকিৎসা ও শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেন। আহত লুৎফর রহমান বলেন, “সকাল ১০টার দিকে বালানগর মোড়ে কাঁচি প্রতীকের ব্যানার লাগিয়ে একটা চায়ের স্টলে কেবল বসেছি। এ সময় নৌকার কয়েকজন কর্মী এসে আমাকে টেনে বের করে মার শুরু করে। আমি পড়ে গেলে পা দিয়ে আমার বুকে পেটে লাথি মারে। পরে স্থানীয় লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।”
রজনী কান্ত বলেন, ভবনীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল মালেক মঙ্গলবার বিকাল থেকে পাহাড়পুর গ্রামে কাঁচি প্রতীকের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন তারা।
“সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে বিদায় দিয়ে একটা চায়ের দোকানে কেবল ঢুকতে গেছি। এ সময় নৌকার কিছু সমর্থক এসে আমাদের লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করে। তাতে আমার মাথা ফেটে যায়, অজিতের হাত ভেঙে যায়। এ অবস্থায় আমরা দৌড়ে পালিয়ে নিজের রক্ষা করি। পরে পরিবারের লোকজন আমাদের বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসে।”
তাদের দেখতে রাতে হাসপাতালে গিয়ে এনামুল হক বলেন, “দুটো ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেওয়া হবে। আমি এসব ঘটনার বিচার দাবি করি প্রশাসনের কাছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ শান্ত বাগমারাকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। যখন তখন যত্রতত্র আমার লোকজনকে পেটাচ্ছে। তবে বাগমারাবাসী এসকল নির্যাতনের জবাব দেবে আগামী ৭ জানুয়ারি ব্যালটের মাধ্যমে। আমি শুধু ধৈর্য্য ধরে দেখে যাচ্ছি আর প্রশাসনের কাছে বিচার দিচ্ছি। কিন্তু মানুষের ধৈর্য্যেরও তো লিমিট আছে।”
এনামুল হক দাবি করেন, নৌকার সমর্থকরা এ পর্যন্ত কাঁচি প্রতীকের ২৬টি নির্বাচনি ক্যাম্প ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। উপজেলার ২৭ স্থানে কাঁচির কর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৮ জন।
সোমবার বিকালে রিটার্নিং কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সেই বৈঠকের প্রসঙ্গ ধরে এই স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, “কালাম অঙ্গীকার করেছিলেন বাগমারায় আর কোনো সহিংসতা হবে না; কিন্তু কালাম কথা রাখেনি। রাতে আমার তিনটি নির্বাচনি অফিস আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনজন কর্মীকে পেটানো হয়েছে।” স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “গভীর রাতে কে কার অফিসে আগুন দিয়েছে তা বলতে পারছি না। তবে আমার লোকজন এটা করেনি। এছাড়া তাদের তিন কর্মীকে পেটানোর ঘটনার সঙ্গেও আমার লোকজন জড়িত না।”
বাগমারা থানার ওসি অরবিন্দ সরকার বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব সহিংসতা ঘটেছে, সেগুলোর অভিযোগ তদন্ত করে এখন পর্যন্ত সাতটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাঁচজনকে।
“তিনটি নির্বাচনী কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া এবং পৃথক ঘটনায় তিনজনকে মারপিট করার অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুলের প্রতিনিধির অভিযোগ পেয়ে জেলা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তিনটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।” রাজশাহীর পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান বলেন, “সোমবার এই আসনের প্রধান দুই প্রার্থীকে আমরা ডেকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছি। এরপরও যদি কেউ সতর্ক ও সংযমী না হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”
রাজশাহীর এ আসনে ভোটের লড়াইয়ে আছেন মোট ছয়জন। তারা হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টানা তিনবারের এমপি এনামুল হক (কাঁচি), তাহেরপুর পৌরসভার টানা তিনবারের মেয়র ও পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ (নৌকা), উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবু তালেব (নাঙ্গল), বিএনএমের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম রায়হান, এনপিপির জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বাবুল হোসেন।
এনডিটিভি/২৭ ডিসেম্বর