ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪

সাত কলেজের আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি সংকটের শঙ্কা

অক্টোবর ৩১, ২০২৪
শিক্ষা
সাত কলেজের আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি সংকটের শঙ্কা

ডেস্ক রিপোর্ট: শিক্ষার মান বৃদ্ধির কথা বলে ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয় রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজকে। এগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। কিন্তু অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকেই পরীক্ষা, ক্লাসসহ সার্বিক লেখাপড়া নিয়ে সমস্যায় পড়েন এসব কলেজের দেড় লাখ শিক্ষার্থী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানের দাবিতে বিভিন্ন সময় রাস্তায় নেমেছিলেন। তবে গত আগস্টে সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে তাদের দাবিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা ‘স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়’ দাবিতে বেশকিছু দিন থেকেই আন্দোলনে রয়েছেন।

এদিকে, তাদের কর্মসূচির কারণে ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ নাগরিকদেরও। দুর্ভোগ বাড়ায় তারাও শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখছেন না। অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দেশের জন্য বিষফোড়া হবে। তাতে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিত সম্ভব হবে না। আবার কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। কর্মসূচি দীর্ঘায়িত হলে সমস্যা আরও বাড়বে। সেজন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মন দিতে বলেছেন শিক্ষাবিদরা। পাশাপাশি সরকারকে শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত সমস্যাগুলো সমাধানেও মনোনিবেশের পরামর্শ তাদের।

শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির কারণে জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি না করে ধৈর্য ধরার ও নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি।

জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঢাবির সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সাত কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। তাদের বিভিন্ন বক্তব্যেও দ্বন্দ্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাবি তাদের ৪০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। এর ওপর সাত কলেজের দেড় লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা, ফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি, ফরম পূরণ, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বড় ধরনের জনবল দরকার হলেও সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। সেজন্য ঢাবি থেকে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে ২০১৯ সালে আন্দোলনও হয়েছিল। যদিও সেটি ছাত্রলীগের হামলার কারণে বিফলে যায়। আবার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিগত সময়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। এখন তারা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুলেছে। তবে সাত কলেজের অন্যতম সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চাইলেও অন্য পক্ষ তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের দাবিতে আন্দোলন করছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য কলেজগুলোর পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার সাতটি কলেজের মধ্যে পাঁচটিতেই উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা চলমান রয়েছে। বিষয়টি নিয়েও কোনো সমাধানের পথ সামনে আসেনি।

জানতে চাইলে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রফিক উদ্দিন রায়হান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য যা যা দরকার, সবকিছুই আছে তিতুমীর কলেজের। তবে যারা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছেন, তারা যেন সাত কলেজ ব্যবহার না করে ছয় কলেজ ব্যবহার করেন।

স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনকারী এই কলেজের শিক্ষার্থী মো. সানি বলেন, শিক্ষার মান বাড়াতে সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো। কিন্তু একটি অ্যাফিলিয়েট সার্টিফিকেট ছাড়া আমরা অন্য কিছুই পাইনি। এতদিন আমরা শুধু সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়ে গেছি, কাজ হয়নি। এখন যেহেতু বৈষম্যহীন সরকার ক্ষমতায়, সেজন্য আমরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করছি। এজন্য সরকারের খুব বেশি আর্থিক খরচও হবে না।

আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, সাত কলেজ নিয়ে ৩৭টি বৈষম্য, যা গত সাত বছরেও দূর করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাত কলেজের পর্যাপ্ত অবকাঠামো আছে। সেগুলো ব্যবহার করা যাবে। কোন কলেজের ক্যাম্পাসে কোন ফ্যাকাল্টি থাকবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। তবে এজন্য পরিকল্পনা লাগবে। ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর অবকাঠামো থাকলেও ভর্তি করানো হচ্ছে দেড় লাখ। সেটি কমিয়ে আনতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে অবস্থিত একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি অনেক বড় বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় হতে গেলে তার শিক্ষক, অবকাঠামোসহ বেশকিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এসব নিশ্চিত করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগে। রাতারাতি চাইলেও সম্ভব নয়। আমাদের একটি বড় সমস্যা হলো ক্যাডার সমস্যা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় আমরা ৩০০ ক্যাডার হারিয়েছি। তার পরও সরকার কী করবে, আমরা তা জানি না। ক্যাডার পদ যদি চলে যায়, আমরা নিশ্চয়ই তা মানব না। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপদস্থ, যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন তারাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সবাই মিলে আমরা একটি সহজ সমাধানের দিকেই যাব। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী দ্রুত কমিশন গঠন হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের আগে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সাত কলেজের জন্য উইং করা উচিত।

ঢাকা উত্তর সিটিতে অবস্থিত একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কিছু বলা ঠিক হবে না। এটি নীতিনির্ধারণী বিষয়। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে যৌক্তিক দাবিগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা। তবে আলোচনাই একমাত্র সমাধানের পথ হতে পারে।

এদিকে, কলেজগুলোর শিক্ষা ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কলেজ) সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও সেই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ অনু বিভাগ) মোহাম্মদ খালেদ রহীম কালবেলাকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে একটি বৈঠক করেছি। কলেজগুলোর অধ্যক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে নিজ নিজ কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে তাদের সমস্যাগুলো জানার জন্য। এরপর মন্ত্রণালয়ের কমিটিও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসবে। সবগুলো কলেজ তো সমান নয়, বিভিন্ন সমস্যা আছে। ছয় সপ্তাহের মধ্যে আমাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আমরা সেটাই করব।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, মুখে বলে দিলেই স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে? তাতে কি মান উন্নত হয়ে যাবে? মনে রাখতে হবে, একটি জনপ্রিয় সিদ্ধান্তও সার্বিকভাবে দেশের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ফান্ড দিতে হবে, মানসম্মত শিক্ষক দিতে হবে, গবেষণার সুযোগ দিতে হবে। এটি মোটেই সহজ কাজ নয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এটা মানতেই হবে, যে মানের শিক্ষক দরকার, তা এখন আমাদের নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থী যোগ হয়ে তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ৪০ হাজারের সঙ্গে ২ লাখ শিক্ষার্থী যোগ করে কোনো লাভ নেই। এখন শিক্ষার্থীদের রাস্তায় কর্মসূচি পালন করে নিজেদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। তাদের উচিত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সময় ব্যয় করা।

 

এনডিটিভি/এলএ