মো: তানজিম হোসাইন
ফিলিস্তিন, যেখানে প্রতিটি দিন শুরু হয় ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, প্রতিটি রাত শেষ হয় রক্তপাত আর শোকের কাহিনী দিয়ে। এখানে আর গোলাপ ফুটে না, বাতাসে ফুলের সুবাস নেই, কেবল বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। যুদ্ধই যেন জীবনের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বঞ্চিত হওয়াই যেন নিয়তি।
প্রতিটি বাড়ি এখানে একেকটি শোকের স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে কোনো না কোনো প্রিয়জন ইসরাইলী বর্বরতায় শহীদ হয়েছে। বাবা-মা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠায়, কিন্তু জানে না তারা আর ফিরবে কিনা। সন্তানদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যেন বিলাসিতা। এখানে প্রতিটি শিশুই জন্ম থেকে লড়াই করতে শিখে যায়—লড়াই জীবন রক্ষার, লড়াই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার।
গত বছরের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নিরলস হামলায় গাজায় মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার ছুঁই ছুঁই। এই নির্মম ধ্বংসযজ্ঞে আহত হয়েছেন আরও ৯৫ হাজার ৯২১ জন, যারা জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কেবল আর্তনাদ করছেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজা এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ, যেখানে মায়ের কোল খালি, শিশুরা খাদ্য আর পানি বিনা চিৎকার করে কাঁদছে। গাজার ৮৫ শতাংশ মানুষ সব হারিয়ে আশ্রয়হীন; জীবন রক্ষার শেষ সম্বলটুকুও তাদের হাতছাড়া। চারদিকে শুধু কান্না, আর্তনাদ আর অমানবিকতার করুণ সাক্ষী।
তবু, পৃথিবী নীরব। আমেরিকা আর পশ্চিমা বিশ্ব যারা মানবাধিকারের কথা বলে, তারাই ইসরাইলের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞকে আত্মরক্ষা বলে বৈধতা দেয়। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশু, নারী, বৃদ্ধ বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কান্না, তাদের চিৎকার কারও কাছে পৌঁছায় না। যেন এই মানুষগুলো পৃথিবীর কোনো অংশ নয়, এক পরিত্যক্ত জনপদের বাসিন্দা, যাদের কথা বলার কেউ নেই।
ফিলিস্তিন যেন এক অবহেলিত পল্লী, যার দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। এখানে নেই শান্তির স্বস্তি, নেই অধিকার। প্রতিটি পরিবারে আছে কষ্ট, প্রতিটি ঘরে আছে শোক। তাদের জন্য পৃথিবীর দরজা বন্ধ, তাদের আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে যায়, কিন্তু কেউ শোনে না।
এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায়, ফিলিস্তিনের মানুষগুলো আশাবাদী। তারা জানে, তাদের ভাগ্য কঠিন, কিন্তু তারা তা মেনে নেয়নি। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই লড়াই করে যাচ্ছে, যেন তাদের হাসি আর ভালোবাসা দিয়েই মৃত্যুকে পরাজিত করবে। প্রতিদিন ফিলিস্তিনের মানুষ তাদের স্বপ্ন আর আশাকে বুকের গভীরে ধরে রেখে যুদ্ধে টিকে থাকে। এখানে মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও জীবনের প্রতি ভালোবাসা হারায় না। হাসিমুখে তারা মৃত্যুকে বরণ করে নেয়, যেন প্রতিটি মৃত্যু তাদের জন্য এক নতুন লড়াইয়ের জন্ম দেয়।
বিশ্ব নীরব এবং এই নীরবতার প্রতিধ্বনি হয়তো একদিন আমাদেরকেই তাড়া করবে। ফিলিস্তিনের এই শহীদ শিশুরা হয়তো আল্লাহকে সব বলে দিয়েছে—তাদের উপর জুলুম, তাদের কষ্ট, তাদের বেদনা, আর আমাদের এই অপরাধের নীরবতা।
এই অমানবিকতা আর নিরবতার মাঝে, ফিলিস্তিনের মানুষরা হাল ছাড়েনি। তারা প্রতিদিন নিজের কষ্ট আর বঞ্চনাকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকে, লড়ে যায়।
ফিলিস্তিনের আকাশে প্রতিদিন বোমা ঝরে, কিন্তু প্রতিটি শিশুর মুখে একটাই স্বপ্ন—একদিন গোলাপ ফুটবে, ফুলের সুবাসে বাতাস ভরে যাবে, আর এই যন্ত্রণার গল্প শুধু স্মৃতি হয়ে থাকবে।
ফিলিস্তিন আজ শুধুই রক্তে ভেজা মাটি নয়, বরং এক দীর্ঘশ্বাসে আবদ্ধ ইতিহাস। ইসরাইলি আগ্রাসনে ছিন্নভিন্ন হওয়া এই ভূমিতে প্রতিদিনই ঝরছে নিরপরাধের রক্ত। এখানে মায়ের চোখের জল আর শিশুর নিঃশব্দ কান্না যেন পৃথিবীর অন্তর্দাহের সাক্ষী। এই মানবিক বিপর্যয় আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, প্রশ্ন তোলে—মানবতার সীমানা কোথায়? যদি এই নৃশংসতা দেখে আপনার মন না কাঁদে, তবে আপনি শুধু নীরব দর্শক নন, হয়তো মানুষও নন।
এনডিটিভি/এলএ